• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১৯ পূর্বাহ্ন

গ্যাস-বিদ্যুতে জাঁতাকলে: মহামানুষদের সুদিন  

Reporter Name / ১২ Time View
Update : সোমবার, ৪ মার্চ, ২০২৪

-রিন্টু আনোয়ার
আর্থিক খাতে চাপ সামলাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে একের পর এক দাম বাড়াচ্ছে সরকার। ২০২২ সালের জুনে গ্যাসের দাম গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। ৭ মাস পর এবার গ্যাসের দাম বাড়ল ৮২ শতাংশ। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে প্রাকৃতিক গ্যাসের ৮২.১০ শতাংশ দাম বেড়েছে। এখন আবারও বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যন্ত্রণা। শিগগিরই বুদ্ধির লম্পঝম্প ভর করবে পানিতেও। এই বৃদ্ধিকে সরকারিভাবে বৃদ্ধি বলা হয় না। বলা হয় সমন্বয়। রমজানের আগে আগে দাম বৃদ্ধির এ যন্ত্রণা আরোপের বার্তা দিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বিদ্যুতে ভর্তুকি থেকে বের হতে দাম সমন্বয় করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ট্যারিফ পুনর্নির্ধারণের ব্যাখ্যায়  জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে- বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ এর ধারা ৩৪ক তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, জনস্বার্থে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের বিক্রয়মূল্য ফেব্রুয়ারি বিলিং মাস থেকে থেকে প্রতি ঘনমিটার ১৪ টাকা থেকে ১৪.৭৫ টাকা (সমন্বয়ের হার ৫.৩৬%) এবং ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য প্রতি ঘনমিটার ৩০ টাকা হতে ৩০.৭৫ টাকা (সমন্বয়ের হার ২.৫০%) নির্ধারণ করেছে।
দেশে গ্যাস ব্যবহারকারীদের শ্রেণি রয়েছে ৮টি। তার মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩৭%, শিল্পে ২৩%, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ১৮%, গৃহস্থালিতে ১০%, সার উৎপাদনে ৭%, সিএনজিতে ৪% এবং বাণিজ্যিক ও চা শিল্পে ১% গ্যাস ব্যবহৃত হয়। প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন, আমদানি, সরবরাহ মূল্যের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের পার্থক্যের কারণে সরকারকে এ খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৬,৫৭০.৫৪ কোটি টাকা। ভর্তুকিকে খুব বড় করে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। যেন এটি বড় রকমের সমস্যা। কিন্তু, বিদ্যুৎ-গ্যাস সেক্টরে চুরি-দুর্নীতিকে দেয়া হয় আড়াল করে।  সেটাকে নাম দেয়া হয় সিস্টেম লস । ওই চুরি বা সিস্টেম লসকে বার বার এডজাস্ট করা হচ্ছে বার বার দাম বাড়িয়ে । মানুষের উপর চাপ বাড়িয়ে । একস্পার্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ-ও গ্যাসের মূল্য  বৃদ্ধি নয়, এ দুটি খাতে চলমান দূর্নীতি বন্ধ করলে ভর্তুকি লাগবে না।
২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন অনুযায়ী গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো শুরু করেন। যেখানে বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করেন এবং ভোক্তারা এর বিপক্ষে তাদের যুক্তিগুলো তুলে ধরেন এবং বিইআরসি উভয় পক্ষের যুক্তিতর্কগুলো যাচাই-বাছাই করে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেন। জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্টরা বারবার অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্বারোপ করলেও বাপেক্স বা জ্বালানি মন্ত্রণালয় গ্যাস আমদানিতেই বেশি মনোযোগী। সরকার ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিইআরসি আইন সংশোধন করে এই ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নেন। তারপর থেকেই নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসলো। যদিও সরকার আইন সংশোধনের সময় আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে নিয়মিত দাম সমন্বয় করতে চায় বলে যুক্তি প্রদর্শন করেছিল।
রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তিগুলো এ নিয়ে আন্দোলন জমাতে পারেনি, পারছেও না।  মানুষকে ভরসা দেখাতে পারছে না। সেইক্ষেত্রে মানুষের ভরসা একটাই যদ্দূর সম্ভব খরচ কম করা, খরচে কাচছাট করা। আর বোবা কান্না করা। জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে আয় না বাড়লে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে কেনাকাটায় কিছু কাটছাঁট করতেই হয়। কিন্তু কোনটা কাটবে আর কোনটা ছাঁটবে তা ঠিক করা সীমিত আয়ের মানুষের জন্য বড় কঠিন। দামের ওঠানামার সঙ্গে সাধারণভাবেই বলা হয়, চাহিদা ও জোগানের সম্পর্ক আছে। চাহিদা বেশি, জোগান কম তাহলে দাম বাড়বে আর জোগান বেশি, চাহিদা কম তাহলে দাম কমবে এটা তো পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয়। কিন্তু চাহিদা আছে, জোগানও আছে অথচ দাম বাড়ছেই ক্রমাগত, তখন কী হবে? পাল্লা দিয়ে আয় বাড়লে তো সমস্যা ছিল না।  কিন্তু আয় না বাড়লে? কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ, মেজাজ চড়ানো ছাড়া করার কিছু নেই। সেই মেজাজটা দেখাবেই কার ওপর? যারা দাম বাড়ায় তারা ক্ষমতাবান। যারা কিনে খায় তারা ক্ষমতাহীন। ফলে ভরসা সেই পুরনো বুদ্ধি আয় বুঝে ব্যয় কর, খরচের কাটছাঁট কর। কিন্তু পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বাড়ি ভাড়া, গাড়ি ভাড়া চাল, চাল আটাসহ কিছু নিত্যপণ্যের খরচ কতোটা কাটছাট করা সম্ভব?
বাস্তবতা হচ্ছে দ্রব্যমূল্য কমানো দূরে থাক নিয়ন্ত্রণে আনার পথও রুদ্ধ প্রায়। একদিকে সিন্ডিকেট, আরেকদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের অবিরাম দাম চড়ানো। সামনে আরো চড়বে। সেই পথ সরকার করেই রেখেছে। অথচ, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের যে দাম তাতে দেশের বাজারে দাম আরও কমার কথা। তবে সরকারের তরফে বলা হচ্ছে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারে তেলের দাম আরও বেশি হওয়ার কথা। ক্ষমতাবানদের কথার দামই বেশি। তেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় অন্য জ্বালানির তুলনায় তিন গুণের বেশি তবুও সারা বছরই তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে সরকার। বসে থাকছে গ্যাস ও কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার বড় একটি বড় অংশ। পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন তিন ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ১০ শতাংশ কমালে বছরে সাশ্রয় হতে পারে অন্তত নয় হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ বকেয়া। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের দেনাও শোধ করা যাচ্ছে না। তার মধ্যে আমদানির জন্য ডলার সংকট রয়েছে। জ্বালানি তেল আমদানি করতে ডলার লাগে সত্য। সেই ডলার দিয়ে গ্যাস ও কয়লা আমদানি করা যায়।
জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্টরা বারবার অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্বারোপ করলেও বাপেক্স বা জ্বালানি মন্ত্রণালয় গ্যাস আমদানিতেই বেশি মনোযোগী। তাই সরকারের নীতি সংশোধন না করে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। বলঅ হচ্ছে, দেশে দিনে এখন গ্যাসের মোট চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এলএনজিসহ গড়ে সরবরাহ করা হয় ২৬৬ কোটি ঘনফুট। এর আগেও আমদানি করে সরবরাহ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুই দফা (২০১৯ ও ২০২২ সালে) গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল। পরবর্তীতে গ্যাস আমদানি বাড়েনি; বরং ২০২২ সালের জুলাই থেকে সরকার খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রেখেছে। ফলে আমদানি করা গ্যাসের সরবরাহ দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট থেকে ৪০ কোটি ঘনফুটে নেমেছে। তাই এবারও দাম বাড়ানো হলে চাহিদা অনুসারে গ্যাস মিলবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
এর পেছনে দেশের সীমানার বাইরের বিষয়ও রয়েছে। আইএমএফের ঋণ পেতে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। আবার সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার মতো স্বাভাবিক আর্থিক সংগতিও নেই। তাই সব মিলিয়ে গ্যাস খাতের খরচ তুলতেই দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকার ২০২৩ সালে বিদ্যুৎ খাতে ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রেখেছে। তবে জ্বালানির দাম বাড়ায় ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ৪৪ হাজার কোটি টাকা। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ায় ঘাটতি আরও বাড়বে। পুরোটাই একটা চেইন। গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের উৎপাদন এবং হোটেল রেস্তোরাঁয় এমনকি পোল্ট্রি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প খাতেও খরচ বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ীরা এই বাড়তি খরচগুলো ভোক্তার পকেট থেকে তুলবে।
ব্যবসায়ী ও শিল্প উৎপাদকরা যখন তাদের কোনো পণ্যের দাম নির্ধারণ করেন তখন যাবতীয় আনুসাঙ্গিক খরচগুলো ধরেই হিসাব কষেন। বিশেষ করে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় শিল্পের জন্য গ্যাসের ইউনিটের দাম একই নির্ধারণ করার কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবেন। তারা বড় শিল্পের সাথে পাল্লা দিয়ে ঠিকতে পারবে না। তখন ব্যবসা বাণিজ্যে আবারও বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের আধিপত্য বাড়তে পারে। তবে দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি করে জ্বালানি খাতের সামগ্রিক অনিয়ম, অব্যবস্থাপনাকে আড়াল করা হচ্ছে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর অনিয়ম, অপচয় ও বেশি দামে এলএনজি আমদানির বন্ধ করলেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়তো না।
বেশ কিছুদিন ধরেই ব্যবসায়ীরা গ্যাস সংকটে তাদের কষ্টের কথা বলছিলেন। গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না বলে সয়াবিন তেল ও চিনিসহ অনেক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির নতুন একটি উপসর্গ সামনে আসে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি স্বাভাবিক আছে বলে দাবি করা হয়েছিল। এখন গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোতে সবধরনের নিত্যপণ্যের দাম চড়ানোর টেকসই নতুন অজুহাত পেল ব্যবসায়ী। আর এর মধ্য দিয়ে নিম্ন, মধ্য শ্রেণির মানুষ আরেক দফা জাঁতাকলে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category