• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৩৫ পূর্বাহ্ন

দূর দ্বীপের তিন তারকা

Reporter Name / ১৬ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

দেশের অন্যতম পর্যটনস্থান সেন্ট মার্টিন। নির্জনে দু’দণ্ড শান্তির খোঁজে দেশ-বিদেশের পর্যটক দ্বীপটিতে আসেন। কিন্তু, সেখানে স্থানীয়দের রাত কাটে নির্ঘুম। ছোট্ট সেই জনপদের মানুষ প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তার সঙ্গে সেখানে জীবনযাপন করেন। দ্বীপের ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা, পিছিয়ে পড়া সংস্কৃতি আর পর্যটননির্ভর অর্থনীতি এর অন্যদম কারণ।

স্থানীয়রা স্বপ্ন দেখেন, দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারাও জীবন গড়বেন। ছড়িয়ে পড়বেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। জড়াবেন নানা পেশায়। অবদান রাখবেন দেশের  অর্থনীতিতে। সেই চেষ্টায় অনেকে এগিয়ে গেলেও, সিংহভাগ দ্বীপবাসীর সেই স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না। তবে যারা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন এই লেখায় তাদের প্রতিনিধি হিসেবে তিনজনকে তুলে ধরা হলো। এদের মধ্যে একজন রয়েছেন আইন পেশায়, একজন বুয়েট এবং অন্যজন নটর ডেমের শিক্ষার্থী।

এম কেফায়েত খান দ্বীপের একমাত্র আইনজীবী

সেন্ট মার্টিনের স্থানীয়দের মধ্যে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, এমন গুটিকয়েক উদাহরণের একজন অ্যাডভোকেট এম. কেফায়েত উল্লাহ খান। বয়স ৩৩। এ দ্বীপে বসবাসকারীদের মধ্যে তিনি ঢাকা জজকোর্টের প্রথম ও একমাত্র আইনজীবী। কেফায়েত খানের বাবা ফিরোজ আহমদ খান পেশায় ব্যবসায়ী ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান। মা মমতাজ বেগম গৃহিণী। সেন্ট মার্টিন বিএন ইসলামিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও চট্টগ্রাম বাকলিয়া সরকারি কলেজ থেকে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন।  এরপর ঢাকায় চলে আসেন কেফায়েত খান। বাংলাদেশ ল’ কলেজ থেকে এলএলবি ও নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে এলএলএম শেষ করে যোগ দেন আইন পেশায়।

 

দ্বীপের পরিবেশ- প্রতিবেশ ঠিক রাখার জন্য কেফায়েত খান অহর্নিশি কাজ করে যাচ্ছেন। পর্যটনবান্ধব সেন্ট মার্টির গঠনে তিনি সদাজাগ্রত। অসাধু ব্যবসায়ীদের থেকে দ্বীপের পরিবেশ রক্ষা, প্রবালের মৃত্যুরোধ, শব্দদূষণ কমানো, বাল্যবিয়ে রোধসহ সামাজিক সেবায় তিনি দ্বীপের মডেল।

কেফায়েত খান বলেন, দ্বীপ ও দ্বীপবাসীর স্বার্থে ইতিবাচক দিকগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমি কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু এই জনপদের প্রধান সমস্যা দরিদ্র্য। বাড়তি আয়ের আশায় এখানকার শিশুরাও কষ্টসাধ্য কাজ করে। স্থানীয়দের সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনায় প্রথমে আর্থিক অবস্থা উন্নত করতে হবে।

আয়াজ উদ্দিন দ্বীপ থেকে বুয়েটে পড়া একমাত্র ছাত্র

মাত্র ২৪ বছর বয়সের টগবগে তরুণ মো. আয়াজ উদ্দিন। বাবা মো. ওমর আজিজ ব্যবসায়ী। মা রশিদা বেগম গৃহিণী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট আয়াজ। পড়ালেখা করেছেন দ্বীপের জিঞ্জিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। উচ্চমাধ্যমিকেও পড়েছেন দ্বীপের সেন্টমার্টিন বিএন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করেন। বর্তমানে বুয়েটের বস্তু ও ধাতব কৌশল বিভাগের ৭ম সেমিস্টারে পড়ছেন তিনি।

 

সেন্ট মার্টিন থেকে বুয়েটে পড়ুয়া সর্বপ্রথম শিক্ষার্থী আয়াজ। পরিবারের ছোট এই ছেলেটি শুধু পরিবারের নয়, এখন পুরো দ্বীপবাসীর গর্বের। দ্বীপের প্রতিটি মানুষ তাকে চেনে- জানে। আয়াজের স্বপ্ন- দেশের প্রখ্যাত পৌকশলীদের তালিকায় নাম লিখিয়ে সেন্ট মার্টিনের মুখ উজ্জ্বল করবেন। এ ছাড়াও দ্বীপের পরিবেশ নিয়েও ভাবেন তিনি। ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও পলিথিন নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার প্রচারণা চালান।

দ্বীপের শিশুগুলোকে ‘মানুষের মতো মানুষ’ করার কিছুটা দায়ভার নিয়েছেন তিনি। তিনি মূলত কাজ করেন অনুপ্রেরণার। কোন শিক্ষালয়ে পড়লে কি হবে, কোন বিষয়ে পড়ালেখার পরে কোন পেশায় সুযোগ হবে। সায়েন্স- আর্টস- কমার্স- ডিপ্লোমা- ভকেশনাল- কারিগরি পড়লে কোথায় কোন পদে চাকরি মিলবে-  দ্বীপের ছেলেমেয়েদের সবকিছুর তালিম দেন আয়াজ।

আয়াজ বলেন, সেন্ট মার্টিনের সর্বসাধারণের জন্য কিছু করতে চাই। পাশে দাঁড়াতে চাই। আমার স্বপ্ন সেন্ট মার্টিনের প্রতিটি শিশু একদিন দেশের প্রতিটি সেক্টরে অবদান রাখবে।

আশরাফ গণি-পড়ছেন নটর ডেম কলেজে

ব্যবসায়ী ও বর্তমান চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান ও গৃহিণী সমজিদা বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে মেজ আশরাফুল গনি (আশরাফ)। ২০০৬ সালে জন্ম নেওয়া আশরাফের বয়স এখন ১৭। এই বয়সেই তিনি দ্বীপের আইডল।

কক্সবাজার মডেল হাইস্কুল থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি শেষ করেন আশরাফ। এরপর ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির সুযোগ হয় ঢাকার নটরডেম কলেজে। প্রত্যন্ত দ্বীপ থেকে নটরডেম পর্যন্ত এই যাত্রা নিয়ে কথা বলেন এই নটরডেমিয়ান। জানান জীবনের লক্ষের কথা। বলেন, আমি পড়ালেখা শেষ করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হতে চাই। যাতে আমি জন্মস্থানকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারি।

কেন তারা উদাহরণ

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা ও ট্রলার লাইনম্যান করিম মিয়া বলেন, তাদের সফলতায় কারণে এখন অনেক পরিবার শিশুদের নিয়ে সচেতন। অনেক পরিবার স্বপ্ন বুনছে- তাদের সন্তানও সম্মানজনক পেশায় জড়াবেন।

সেন্ট মার্টিন বিএন ইসলামিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহজাহান সরকার বলেন, দ্বীপের ছাত্ররা কেউ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, লেখাপড়ার জন্য উন্নত শিক্ষাঙ্গনে চান্স পায়, তখন একরকম তৃপ্তি অনুভব হয়। হয়ত দ্বীপের অনেক শিক্ষার্থী- শিশু ও তাদের পরিবারগুলো আজ কেফায়েত, আয়াজ বা আশরাফের মতোই বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আবার নানা প্রতিকূলতার কারণে সেই স্বপ্ন আটকে যায়। তবে একদিন এই শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত প্রজন্ম সেন্ট মার্টিনকে এগিয়ে নেবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

৬ নম্বর সেন্ট মার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, যদিও সেন্ট মার্টিন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসমৃদ্ধ ভূখণ্ড। দ্বীপটিতে প্রায় ১০ হাজার লোক বাস করে। যার অধিকাংশই দরিদ্র। দারিদ্র্য, অপর্যাপ্ত কর্মসংস্থান, পর্যটক-নির্ভর অর্থনীতি, দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ব্যয়বহুল পণ্য পরিবহনের কারণে এই জনপদে জীবনযাত্রা চলে গরিবি হালে। শিশুরা স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে উঠতে পারে না। তবুও আগ্রহ আর চেষ্টায় কেউ কেউ এগিয়ে যাচ্ছে। এমন এগিয়ে যাওয়ায় যেন কোনো বাধার সম্মুখীন হতে না হয়, সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে এবং থাকবে।

ছেলেদের নিয়ে বাবাদের অনুভূতি

নিজেকে সার্থক মনে করেন কেফায়েত খানের বাবা ফিরোজ আহমদ খান। বলেন, কেফায়েত ছোট থেকেই লেখাপড়ায় আগ্রহী ছিল। আমি জানতাম ওর আগ্রহ ওকে অনেক বড় জায়গায় নেবে।  সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় সে তার স্বপ্ন ছুঁতে পেরেছে। ছেলে দ্বীপবাসীর পাশে দাঁড়ালে নিজেকে ‘সার্থক বাবা’ মনে হয়।

আয়াজের বাবাও গর্বিত তার ছেলেকে নিয়ে। বলেন, ওরা পাঁচ ভাই-বোন। সবাইকে পড়ালেখা করিয়েছি। আয়াজ বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর সবাই যখন ওকে নিয়ে আলোচনা করে, তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়। ওর জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।

আশরাফের বাবা হিসেবে ছেলেকে প্রসঙ্গে কথা হলে চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, আমার ছেলে নটরডেমে পড়বে আমার বিশ্বাসই ছিল না। এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করল, পরে নটরডেমে পরীক্ষা দিয়ে টিকে গেল। এখন আশরাফের লক্ষ্য ‘বিসিএস’। আমি তার স্বাধীনতায় বাধা হই না। ছেলে যা করতে চায় আমি সায় দিই।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category