• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০৩:৫১ পূর্বাহ্ন

নতুন শিক্ষা কারিকুলাম: একমুখীতার কথা বলে বহুমুখীতার প্রবণতা!

Reporter Name / ৩১ Time View
Update : সোমবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৩

-রিন্টু আনোয়ার

কখনো কখনো কিছু বিষয় বুঝতে কিছুটা দেরি হলেও একটা সময় বুঝের আয়ত্বে চলে আসে। শিক্ষার বিষয়টা একটু স্পর্শকাতর । এটা যেন ক্ষমতাসীনদের একটা সুযোগ। অভিভবক, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের বুঝে ওঠার আগেই বাজেট-বরাদ্দসহ কাজটা সেরে ফেলার একটা চালাকি তারা করেন। নতুন শিক্ষাক্রম থেকে দশম শ্রেণির আগের সব পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেওয়ার কাজটাও সেভাবেই করা হয়েছে। আবার এই পাবলিক পরীক্ষা চালুর কাজও অনেকটা এভাবেই  হয়েছিল।
নবম শ্রেণিতে বিভাগ পছন্দের সুযোগ পাল্টে তা নেয়া হয়েছে একাদশ শ্রেণিতে। একাদশে গিয়ে শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো বিভাগে পড়বে। চলতি বছর প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আগামী বছর বাস্তবায়ন করা হবে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। এরপর ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ শ্রেণিতে এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে ধাপে ধাপে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার কথা। এই কারিকুলামে মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষা যেটুকু আছে তাও শেষ হয়ে যাবে, নবম শ্রেণিতে সবার জন্য গণিত ও বিজ্ঞান অভিন্ন পাঠ্যপুস্তক হওয়ায় টপিক আগের চেয়ে কমাতে হবে। ফলে যারা বিজ্ঞান ও গণিত শিখতে আগ্রহী তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এর মাধ্যমে সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ প্রায় নাই হয়ে যাবে। কিন্তু, সরকারের দিক থেকে যুক্তির কোনো অভাব নেই। শিক্ষার্থীদের আনন্দময় পরিবেশে পড়ানোর পাশাপাশি মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে দক্ষতা, সৃজনশীলতা, জ্ঞান ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে শেখাতেই নতুন এই শিক্ষাক্রম চালু করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। বাস্তবটা কি আদৌ সেরকম?
দক্ষতা অর্জনের কথা বলে নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার চেয়ে ব্যবহারিকের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যার ফলে পড়ার চেয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক নানান কাজের চাপ বেড়েছে, যা অনেক অভিভাবকের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা চোখের সামনে দেখছেন, ব্যবহারিকের নামে সন্তানরা পড়তে বসে না। সারাক্ষণ কিসব  অ্যাসাইন্টমেন্টের কথা শোনায়। বন্ধু-বান্ধবের সাথে বসে থাকে। গোটা ব্যবস্থাটা ওই রকমই হয়ে গেছে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক স্তর, অর্থাৎ নার্সারি ও প্লে-তে শিশুদের জন্য এখন আর কোনও বই থাকবে না। শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষকরাই তাদেরকে সরাসরি শেখাবেন।
এরপর প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তাদেরকে মাত্র তিনটি বই পড়ানো হবে। তবে কোনও পরীক্ষা নেওয়া হবে না। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে বছরব্যাপী চলা বিভিন্ন শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। পরে শ্রেণিভেদে ত্রিশ থেকে ষাট ভাগ পর্যন্ত মূল্যায়নই করা হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিখনকালীন সময়ে। শিখনকালীন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগের দক্ষতা, উপস্থাপন, ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট বা বাড়ির কাজসহ বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার কর হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হবে দশটি বিষয়ে। বিষয়গুলো হচ্ছে- ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, বিজ্ঞান ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।
এর মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ। আর সামষ্টিক মূল্যায়ন অর্থাৎ পরীক্ষা হবে ৪০ শতাংশ। এছাড়া শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্প কলায় শতভাগ ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। আর ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের শিখনকালীন মূল্যায়ন ৬০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন বা বছর শেষে পরীক্ষায় থাকবে ৪০ শতাংশ। বাকি বিষয় জীবন ও জীবিকা, তথ্যপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ।
এরপর শিক্ষার্থীদের এখন নবম ও দশম শ্রেণিতে অভিন্ন সিলেবাসে পড়ানো হবে। এর মধ্যে নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের শিখনকালীন মূল্যায়ন ৫০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৫০ শতাংশ। বাকি বিষয়গুলোর শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য- এই তিন বিভাগে ভাগ হবে৷ এখান থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো বিভাগ বেছে নেবে।
এছাড়া নতুন পাঠক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন কেবল দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি অনুসারেই অভিন্ন দশটি বিষয়ের ওপর এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে। একইভাবে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ধরনেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষার পরিবর্তে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দু’টি আলাদা পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ন করে হবে এইচএসসি’র চূড়ান্ত ফলাফল।
আগে যেখানে প্রথম শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হতো, সেখানে এখন প্রাথমিক স্তরে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনও পরীক্ষা থাকছে না। আবশ্যিক বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়গুলোর পরীক্ষা বাদ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে আগে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী-পিইসি, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট-জেএসসি এবং জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট-জেডিসি পরীক্ষা নেওয়া হতো। এসব পরীক্ষা এখন আর নেই।
বাংলাদেশের জন্ম থেকে অনেকগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। প্রতিটি কমিশনের ছিল নিজস্ব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সব শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা শহরের রাস্তার মতো। খোঁড়াখুঁড়ি যেন শেষই হয় না।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে, যেটি ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন নামে বেশি পরিচিত। এরপর ১৯৮২ সালে মজিদ খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৮৭ সালে মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ সালে শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, ২০০১ সালে এমএ বারী শিক্ষা কমিশন, ২০০৩ সালে মনিরুজ্জামান শিক্ষা কমিশন এবং সর্বশেষ ২০০৯ সালে কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়।
নতুন কারিকুলামে কোনো পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। তার পরিবর্তে আছে ধারাবাহিক মূল্যায়নের নামে অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন ও প্রজেক্টনির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতি। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রজেক্ট ও অ্যাসাইনমেন্টের সংযোজন অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। একে বলা হচ্ছে, মুখস্থনির্ভর পরীক্ষাপদ্ধতির জায়গায় একধরনের বৈপ্লবিক চিন্তা।
কখন,কোথায় হলো এ বিপ্লবটা? কারা ঘটালেন? চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূল চ্যালেঞ্জ হলো মানুষ ও রোবটের বুদ্ধিমত্তায় কে টিকে থাকবে, সেই বিষয়ের চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি করণীয় হলো নিজেদের বুদ্ধিমত্তাকে আরও বেশি শাণিত করা, একটি বুদ্ধিদীপ্ত, উদ্ভাবনী ও সৃষ্টিশীল জাতি তৈরি করা। বর্তমান কারিকুলাম দিয়ে বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী তৈরি করে বড় বড় বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী প্রজন্ম তৈরি করা যাবে? খাতায় যা-ই লিখুক প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে অন্তত ৬০% নম্বর পাওয়ার ব্যবস্থা করে? শিক্ষাসূচি, পদ্ধতি নিয়ে এ দেশে কতো যে এক্সপেরিমেন্ট! সৃজনশীল, এমসিকিউসহ কতো কী?
এমনিতেই দেশে অন্তত এগারো-বারো কিছিমের শিক্ষা ব্যবস্থা ধাবমান-চলমান। আবার মাঝেমধ্যে একমুখীতার কথা বলে বহুমুখীতার প্রবণতা। আজ বৃত্তি, কাল বৃত্তি তুলে দেয়া। যখন যেটা মন চায়, সেটার পক্ষে ব্যাপক যুক্তি। আর কিছু লোকের কিছুদিন এর বিপক্ষে মাতামাতি করে ঘরে ফিরে যাওয়া। কিছু লোকের সায় দিয়ে বাহ, বাহ আওয়াজ। কদিন বাদেই আবার সেঠাই বেঠিক। হুজুর যেমন আরেক ওয়াজে গিয়ে আরেকটা বয়ান দেন। তখন সেটাও ঠিক-ঠিক।
পদ্ধতি বদলানোর এ ধারায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর মনগড়া ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার আগে তেমন ভাবনাচিন্তার দরকার মনে করলো না সরকার? নাকি ভেবেছে অন্যকিছু? সরকারি মহলের দাবি, এই কারিকুলাম দিয়ে বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী তৈরি করা যাবে। এতোদিনের কারিকুলাম দিয়ে তা হলে কী হয়েছে?  এখন বড় বড় বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীতে দেশ ভরে উঠবে? অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন একলাফে গাছের মগডালে তোলার এ চিন্তার পরিণাম কী হতে পারে? পা ভেঙে পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী হবে নাতো? খেলার মাঠ প্রস্তুত না করে, খেলা পরিচালনার জন্য একজন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ রেফারি নিয়োগ না দিয়ে একদল খেলোয়াড়কে ফাঁকা মাঠে ছেড়ে দিলে কী হয়?

লেখক ঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category