• সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৬:১৩ পূর্বাহ্ন

পদক্ষেপ জরুরি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে

Reporter Name / ২১ Time View
Update : মঙ্গলবার, ৯ জানুয়ারী, ২০২৪

দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বেশ কিছু পণ্যের দাম ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, অর্থ পাচার এবং উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীল বড় চ্যালেঞ্জে। এছাড়াও গত কয়েক বছরে দেশের অর্থনীতিতে অন্যতম ছিল বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের অভাব। ফলে বেড়েছে বেকারত্ব। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির আকার বাড়লেও মানুষের ভোগ, আয় ও সম্পদে বৈষম্য বেড়েছে। এ অবস্থা উত্তরণে নতুন সরকারের কাছে দ্রুত পদক্ষেপ চান দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বাড়াতে হবে বিনিয়োগ। তারা বলেন, সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা উচিত। এছাড়াও আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ ব্যাংক খাতে সংস্কার জরুরি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে পৃথকভাবে এসব মন্তব্য করেন।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম রোববার গণমাধ্যমকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো মূল্যস্ফীতি। এছাড়াও বৈদেশিক রিজার্ভ কমছে। ডলার সংকটে ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারছেন না।

এসব সংকট সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, অর্থনীতিতে আরেক অন্যতম সমস্যা হলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। দিনদিন এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ফলে খেলাপি ঋণ আদায় এবং নতুন ঋণ খেলাপি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তার মতে, এক দশকে দেশের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। অর্থাৎ বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। এক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সহজে ব্যবসা করার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে। ব্যবসায়ীদের বেশকিছু সমস্যা রয়েছে, এর মধ্যে জমির স্বল্পতা অন্যতম। এক্ষেত্রে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি নেই। এছাড়া সুশাসনের অভাব অন্যতম সমস্যা। সরকারকে বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকের সংস্কারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অর্থনীতিতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে প্রথম হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি। জিনিসপত্রের দাম মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। এ অবস্থায় চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। মানুষের জীবনে যাতে স্বস্তি আসে, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান যাতে অক্ষুণ্ন থাকে এবং পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা যাতে নিশ্চিত হয়, এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে ডলারের সংকট চলছে। ডলার পাওয়া কঠিন। এ অবস্থায় ডলারের সহজলভ্যতা, বিনিয়োগের জন্য এলসি খোলার নিশ্চয়তা এবং কর্মসংস্থানের দিকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশি মুদ্রার আরও কিছুটা অবমূল্যায়ন করা উচিত। পাশাপাশি রাজস্ব নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। এক্ষেত্রে শুল্ক কমিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে সুযোগ নিতে হবে। তৃতীয়ত, সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন জরুরি। এক্ষেত্রে সরকার কয়েকটি আইন করেছে। এর মধ্যে ‘ডাইরেক্ট ট্যাক্স আইন’ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অন্যতম। এসব আইন বাস্তবায়ন করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীলতার নীতি গ্রহণ জরুরি। চতুর্থ বিষয় হলো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ দেওয়া।

কয়েক বছর পর্যন্ত দেশ থেকে টাকা পাচার বাড়ছে। বৈদেশিক বাণিজ্যসহ নানা উপায়ে টাকা পাচারের কথা শোনা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানির তথ্য-উপাত্তে গড়মিল পাওয়া যাচ্ছে। ফলে এসব বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সর্বশেষ বিষয় হলো সর্বক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন প্রকল্প যাতে সাশ্রয়ীভাবে বাস্তবায়ন হয়, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এর অন্যতম অংশ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। আর মূল্যস্ফীতির একটি বড় কারণ হলো ডলার সংকটের টাকার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ টাকার দাম আগের চেয়ে ৩০ শতাংশ কমলে সেটি মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলেছে। অর্থাৎ জিনিসপত্রের দাম ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এতে বাড়তি দামের কারণে আমদানি শুল্কও বেড়েছে। ফলে এই শুল্কের একটি অংশ ছাড় দিয়ে জিনিসপত্রের দাম কমানোর কথা ভাবতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে মুদ্রানীতি সংকোচন করা হয়েছে। এটি আরও সংকোচন করার প্রক্রিয়া চলছে। এক্ষেত্রে রাজস্বনীতিও সংকোচন করা জরুরি। অর্থাৎ আমাদের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হবে। তার মতে, সামগ্রিকভাবে ব্যয়ের গুণগত মান বাড়াতে হবে। উন্নয়নমুখী ব্যয় হবে। কিন্তু ১ টাকার খরচ যেন দেড় টাকা না হয়, সেটি নজর দেওয়া জরুরি। ড. আতিউর রহমান বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার অস্থিতিশীল। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক হারের মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে। এটি কমাতে উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে মুদ্রার বিনিময় হার ধীরে ধীরে বাজারভিত্তিক হারের দিকে আগাতে হবে। পাশাপাশি রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ানো জরুরি। তবে বিনিময় হারে ভারসাম্য এলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এমনিতেই বাড়বে বলে আমার ধারণা। তিনি বলেন, প্রবাসীদের মধ্যে যারা কম আয় করেন, তাদের জন্য প্রণোদনা একটু বাড়ানো উচিত। এছাড়াও ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বর্তমানে নেতিবাচক। এটি ইতিবাচক করতে হবে। এক্ষেত্রে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ও বিদেশি ঋণ বাড়ানো এবং আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। ড. আতিউর রহমান আরও বলেন, জিনিসপত্রের দামের কারণে গরিব মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। ফলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়িয়ে নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে দেশে বিশাল আয় হলেও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য সীমাহীনভাবে বেড়েছে। সিপিডির তথ্য অনুসারে, ৫ বছরে জিনিসপত্রের দাম বেসামালভাবে বেড়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন পণ্যের দাম ৯ শতাংশ থেকে শুরু করে ৪শ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ জিনিসপত্রের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এ অবস্থায় অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। এছাড়াও অর্থ পাচার বৃদ্ধি, দুর্নীতি, উচ্চ খেলাপি ঋণ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকট অন্যতম। এ অবস্থায় আবারও সরকার গঠন করতে যাচ্ছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category