• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০২:৩০ অপরাহ্ন

বিত্তহীন চিত্তে গরিবের ত্রাহি দশা 

Reporter Name / ২৬ Time View
Update : রবিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩

-রিন্টু আনোয়ার

কষ্ট কেবলই বাড়বাড়ন্ত গরিব ও মধ্যবিত্তদের। মধ্যবিত্তকে নিম্মবিত্তের গল্প শুনিয়ে স্বান্তনা সবাই-ই দিতে পারে। মধ্যবিত্তও তাদের করুণ অবস্থা শুনে দম ধরে যায়। আবার কে গরিব, কে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত সেই নির্ণয়কাঠিও বদলে গেছে। দৈনিক আয়সীমার ভিত্তিতে বিশ্বের জনগোষ্ঠীকে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো দুই ডলার বা এর নিচে আয় করলে দরিদ্র শ্রেণি, ২-১০ ডলার আয় করলে নিম্নবিত্ত শ্রেণি, ১০-২০ ডলারে মধ্যবিত্ত, ২০-৫০ ডলারে উচ্চবিত্ত ও ৫০ ডলারের বেশি হলে উচ্চবিত্ত শ্রেণি। কিন্তু, অর্থনৈতিক শ্রেণির সংজ্ঞা-উদাহরণে এখন ওলট-পালট । পিউ রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী মধ্যবিত্তের সংখ্যা ২০২০ সালে মহামারির আগের অনুমানের চেয়ে ৫ কোটি ৪০ লাখ কমেছে। আবার এই সময়ে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দরিদ্রের সংখ্যা বেড়ে অনুমিত সংখ্যার চেয়ে ১৩ কোটি ১০ লাখ বেশি এখন।
শতাংশের হিসাবে ২০২০ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৭ ভাগ মানুষকে মধ্যবিত্ত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। অর্থাৎ, বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের (৫১%) বা গরিব (১০%)। আর উচ্চবিত্তের সংখ্যা মোট সংখ্যার ৭ শতাংশ এবং উচ্চ-মধ্য আয়ের জীবনযাপন করছে প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ। ওয়ার্ল্ড ডেটা ল্যাবের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর একটি পরিবারে প্রতিদিন ১১ থেকে ১১০ ডলার খরচ করেছে—এমন মানুষের সংখ্যা ৩৭৫ কোটি ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বেড়ে ২ হাজার মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। এ অঙ্ক কিন্তু বার্ষিক হিসাবে গণনা করা হয়। আর দারিদ্র্যের হার কমে ২০ শতাংশের কাছাকাছি এসেছে।
পারিবারিক আয়ের ভিত্তিতে ২০১১ সালের বাজার অনুযায়ী ক্রয়ক্ষমতা-পিপিপি ধরা হয়। পণ্য ও সেবার মূল্য সংশ্লিষ্ট দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মুদ্রার বিনিময় হার অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে হিসাব করা হয়। এ ছাড়া ২০২০ সালে বৈশ্বিক এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আয় বণ্টনও হিসাবে নেওয়া হয়। যেমন, বাংলাদেশের কারও ক্ষেত্রে এই ক্যালকুলেটর ২০২০ সালে বৈশ্বিক আয় বণ্টন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অবস্থান নির্ধারণ করে। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের আয় বণ্টনের হিসাবেও ওই ব্যক্তির অবস্থান নির্ধারণে সহায়তা করে এই ক্যালকুলেটর। পিউ রিসার্চ সেন্টার মধ্যবিত্ত ও অন্যান্য ক্যাটাগরির জন্য একটি মান নির্ধারণ করেছে। যেমন, চার সদস্যের একটি পরিবারের দৈনিক আয় ১০ ডলার ১ সেন্ট থেকে ২০ ডলারের মধ্যে হলে তারা মধ্যবিত্ত। এ হিসাবে এই শ্রেণির মানুষের বার্ষিক আয় ১৪ হাজার ৬০০ থেকে ২৯ হাজার ২০০ ডলার। আর বাকি শ্রেণিগুলোর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে—দৈনিক ২ ডলার বা এর কম আয় হলে দরিদ্র, ২ ডলার ১ সেন্ট থেকে ১০ ডলারের মধ্যে আয় হলে নিম্ন আয়ের, ২০ ডলার ১ সেন্ট থেকে ৫০ ডলার হলে উচ্চমধ্যবিত্ত এবং ৫০ ডলারের ওপর হলে তাকে উচ্চবিত্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। হিসাবটি করা হয়েছে ২০১১ সালের ক্রয়ক্ষমতার  মানের ভিত্তিতে।
এসব হিসাব ও বাস্তবতা আমলে নিলে চারদিক এখন গরিবে ঠাঁসা। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল, লবণসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের কারণে তাদের কষ্টের সঙ্গে সন্ধি করা ছাড়া গতি নেই। আয়-রোজগার না বাড়ায় বাজারের তালিকা থেকে সদাই কাটছাঁট করতে হচ্ছে হচ্ছে তাদের। মাসের বাজার খরচ আঁটসাঁট করছেন অনেকে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে সরকারি হিসাবে তা মূল্যস্ফীতি দিয়ে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস মূল্যস্ফীতির হিসাব করে। দেশে গত মাস কয়েক ধরে এই মূল্যস্ফীতি আর সীমা পরিসীমার মাঝে নেই। মূল্যস্ফীতির প্রভাব গরিব মানুষের ওপর বেশি। আয়-ব্যয়ে সমন্বয় না থাকায় ঢাকা ছাড়ছে তাদের অনেকে। রাজধানীর চোখ ধাঁধানো ফ্লাইওভার-মেট্রোরেলে চাপা পড়েছে তাদের দুঃখ-দুর্দশা। নিত্য ব্যয় বাড়লেও, আয় না বাড়ায় সংসার চলাতে হাঁসফাঁস অবস্থায় ঢাকা বা শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়া ছাড়া তাদের আপাতত বিকল্পও নেই। গ্রামে গিয়েও দুদৃশা।
১৪৬৩.৬০ বর্গমিটার আয়তনের রাজধানী ঢাকা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন প্রায় দুই কোটি ৫০ লাখ মানুষ। নানা প্রয়োজনে প্রতিদিন ঢাকায় আসা-যাওয়া করেন কয়েক লাখ মানুষ। ঢাকা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় সারাদেশের মানুষ রাজধানীমুখী। ফলে ঢাকায় বাসাভাড়া বেশ। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বেশি। কর্মজীবীসহ সব শ্রেণির মানুষকে উচ্চ ভাড়ায়, বলতে গেলে বেতনের বা আয়ের সিংহভাগ টাকা দিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। রাজধানী ঢাকার এখন প্রায় সব এলাকার বাসায় বাসায় ঝুলছে টু-লেট। ফলে অনেক বাসা ফাঁকা পড়ে আছে। মালিকরা বলছেন, বিল্ডিং নির্মাণ করতে ব্যয় বেড়েছে। হোল্ডিং ট্যাক্স বেড়েছে। অথচ ভাড়াটিয়ার অভাবে বিল্ডিংয়ের একাধিক ফ্ল্যাট খালি পড়ে রয়েছে।
নানা কারণে ঢাকা থাকতে বাধ্য হওয়াদের বেশির ভাগের আয় কমে যাওয়ায় ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সমন্বয় করতে পারছেন না তারা।  দেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশে গরীবের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। রাজধানীতে বসবাসকারী মধ্যবিত্তদের বড় অংশ ক্রমান্বয়ে নিম্নবিত্তের কাতারে যাচ্ছে। বৃহত্তর উত্তরা, আরামবাগ, মালিবাগ মোড়, শান্তিনগর, আজিমপুর মোড়, সিদ্ধেশ্বরী মোড়, রামপুরা, যাত্রাবাড়ি মোড়, লোহারপুল, কমলাপুরসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার মোড়ে মোড়ে ঝুলছে অসংখ্য ভাড়াবাসার বিজ্ঞপ্তি। যা আগে চোখে এমনটি চোখে পড়েনি! ঢাকার এত বাড়ি বা ফ্ল্যাট প্রায় ফাঁকা! ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাসাভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪শ’ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২শ’ শতাংশ। এতে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাসাভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। অন্য এক জরিপে জানা গেছে, রাজধানীর ২৭ ভাগ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ ভাগ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ ভাগ আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাসাভাড়া মানে আবাসন খাতে। মহানগরের বাসাভাড়া বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিটি পণ্যের মূল্য এখন লাগামহীন। এই লাগামহীনতা ধনীদের কাছে তেমন বিষয় নয়। চালের কেজি দু’শ –তিন’শ টাকায় উঠলেও দেড়-দু’শ ভাগ আয় বৃদ্ধি পাওয়া শ্রেণির এতে সমস্যা হবে না। শ্রেনি আর বিত্ত এখানে আলাদা বিষয়।
শ্রেণির সঙ্গে বিত্তের একটা সম্পর্ক থাকলেও উচ্চবিত্ত বলতেই  প্রাচুর্যপূর্ণ বিত্তসম্পন্নদের কথা মনে আসে।  নিম্নবিত্ত বলতে বিত্তের অভাবে বিপর্যস্ত ও নিগৃহিতদের চেহারা ভেসে ওঠে। মধ্যবিত্ত বললে সেরকম কোনো সুনির্দিষ্ট চেহারা ভাসে না। ফলে, বিত্তের বিচারে কে যে মধ্যবিত্ত সেটাই নির্ধারণ করা দুস্কর। তবু বিত্তের বিচারে এই শ্রেণীটির একটি সংজ্ঞা দাঁড় করাতে চাইলে কেউ হয়তো বলবেন – যে শ্রেণীর বিত্ত-সম্পদের পরিমাণ উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের সম্পদের পরিমাণের মোটামুটি মাঝামাঝি অবস্থানে আছে তাকে বলা যায় মধ্যবিত্ত। কিন্তু এই সংজ্ঞা দিয়ে মধ্যবিত্তকে চিহ্নিত করা যাবে না, কারণ বিভিন্ন দেশে মধ্যবিত্তের সম্পদের পরিমাণ ও জীবনযাপনের ধরন একই নয়। অর্থাৎ এমন কোনো আন্তর্জাতিক পরিমাপ নেই যা দিয়ে সব দেশের মধ্যবিত্তকে চিহ্নিত করা যায়। অন্য দুই শ্রেণীর বিত্তের সঙ্গে তুলনা করতে হলে আগে দেখতে হবে ঠিক কী পরিমাণ সম্পদ থাকলে একজনকে উচ্চবিত্ত বলা যাবে বা ঠিক কতোটুকু বিত্তহীন হলে তাকে আমরা নিম্নবিত্ত বলবো। এই বিবেচনায় একজন ইউরোপীয় বা আরব উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্তের সম্পদের পরিমাণ আর বাংলাদেশের একজন উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্তের সম্পদের পরিমাণ এক নয়। এখানে না উত্তম না অধম এই মধ্যবিত্তের সবচেয়ে বড় সম্পদ এই মূল্যবোধ। তাদের মূল্যবোধ-নীতিবোধ-ঔচিত্যবোধ সবই স্ববিরোধিতায় ভরা। এগুলোতেও জোড়াতালি। এদম নিম্ন ও  উচ্চবিত্তদের এ সমস্যা নেই। তারা সুবিধাজনক ও ক্ষমতাশালী অবস্থানে থাকলেও মূল্যবোধবিষয়ক সমস্যা নেই। তারা যা ইচ্ছা করে, করতেও পারে। তাদের এই ‘যা ইচ্ছা করা’ আর বাদবাকিদের ’কিছু করতে না পারা’ কোন পরণিাম ডেকে আনবে অপেক্ষা এখন সেটারই।

লেখক ঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category