• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০৩ পূর্বাহ্ন

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হ্যাকিংয়ে সর্বস্বান্ত

Reporter Name / ৯ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০২৪

প্রযুক্তিতে বিশ্বের সর্বোচ্চ সুরক্ষিত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো ব্যাংক এখন চরম অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। এখানকার শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্ক্যামাররা (হ্যাকার) প্রতিদিন শত শত প্রবাসীকে সর্বস্বান্ত করেছে। তাদের ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, শেয়ার বাজারের বিনিয়োগ তছনছ করছে। হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ ডলার। স্ক্যামাররা প্রথমে ব্যক্তির ফোন নম্বর হ্যাক করে। এরপর শেয়ার বাজার অ্যাপস দখলে নিয়ে একের পর এক শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। বিক্রির অর্থ তারা তাদের প্রিপেইড ডেবিট কার্ডে ট্রান্সফার করে আত্মসাৎ করছে।

দেশি-বিদেশি এসব হ্যাকাররা এতটাই শক্তিশালী যে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে মাসের পর মাস পার হলেও প্রতিকার মিলছে না। উদ্ধার হচ্ছে না অর্থ। খোদ বাংলাদেশি অনেক মেধাবীদের বিরুদ্ধেও এসব হ্যাকিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর তালিকায় এরকম শতাধিক বাংলাদেশির নাম রয়েছে। এছাড়া আছে ফিলিপাইন, পাকিস্তান ও ভারতীয় হ্যাকারদের নাম। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, স্ক্যামাররা এতটাই ভয়ংকর যে-তাদের খোঁজ পেলেও টিকিটি ধরা যাচ্ছে না। প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্ক্যামাররা যুক্তরাষ্ট্রে জাল ফেলেছে। আর সেই জালে আটকা পড়ছে নিরীহ মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য। নিউইয়র্ক পুলিশের একটি সূত্র জানায়, স্ক্যামাররা দীর্ঘ সময় কোনো ব্যক্তিকে নজরে রাখে। নানা মাধ্যম ব্যবহার করে ব্যক্তির ব্যবহৃত মোবাইল, ব্যাংক হিসাব ও ক্রেডিট কার্ডের প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর সাইবার আক্রমণ চালায়। স্ক্যামাররা প্রথমে মোবাইল ফোনের সিম তুলে নেয়। হ্যাক করে ইমেইল। এরপর একে একে ব্যাংক, শেয়ারবাজার ও ক্রেডিট কার্ডের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে সরিয়ে নেয় অর্থ। এ পর্যন্ত যত অভিযোগ এসেছে, বেশিরভাগ ঘটনায় প্রথমে মোবাইল হ্যাক হয়েছে। এসব মোবাইল ফোনের অধিকাংশই প্রিপেইড অপারেটরের। জানা গেছে, সামান্য কিছু তথ্য দিয়ে সহজেই এসব গ্রাহকদের সিমকার্ডগুলো হ্যাকাররা তাদের কবজায় নিয়ে নিচ্ছে। এরপর ইমেইলের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে একের পর এক চালাচ্ছে সাইবার লুটপাট।

স্ক্যামাররা যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজার থেকেও বহু বাংলাদেশির বিনিয়োগ হাতিয়ে নিয়েছে। মমতাজুল আহাদ নামে নিউইয়র্কের একজন মিডিয়াকর্মী বলেন, শেয়ার বাজার ট্রেডিং অ্যাপস রবিনহুড হ্যাকড করে তার ১৭ হাজার ডলারের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে। অপু কাজী নামে একজন প্রবাসী জানান, তার ফোন নম্বর হ্যাকড করে ব্যাংক থেকে ২০ হাজার ডলার নিয়ে গেছে স্ক্যামাররা।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সোসাইটির অর্থ আত্মসাতের চেষ্টায় মামুন আবু নামে এক বাংলাদেশির নাম উঠে এসেছে। তার বাসা কুইন্সের জ্যামাইকায়। পুলিশ তাকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে। মামুন আবু একজন পেশাদার স্ক্যামার। আগে স্ক্যামে পাকিস্তানিরা জড়িত ছিল বলে শোনা যেত। আর এখন আসছে বাংলাদেশিদের নাম।

স্ক্যামের শিকার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি শাহাদাত ইমন যুগান্তরকে বলেন, গত মাসে সকালে একটি ফোনকলে তার ঘুম ভাঙে। হ্যালো বলার পর অপর প্রান্ত থেকে জানতে চাওয়া হয় এটা জিসানের নম্বর কিনা। রং নম্বর বলে কল কেটে দেন ইমন। পরদিন সকালে একইভাবে ফোনকল রিসিভ করেন তিনি। দিনে আরও দুবার একই ফোন নম্বর থেকে কল রিসিভ করেন ইমন। এভাবে এক সপ্তাহে তিনটি নম্বর থেকে ১৩ বার ফোন পান তিনি। ৭ দিনের মাথায় ইমনের সিমটি অকার্যকর হয়ে যায়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তার ব্যাংক থেকে ২ হাজার ৭০০ ডলার হাওয়া হয়ে যায়।

একইভাবে মাহবুবুর রহমান নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত এক যুবক গণমাধ্যমকে বলেন, অফিসের প্রয়োজনে তিনি প্রিন্টারের কালি অর্ডার করেছিলেন অ্যামাজন ডটকমে। যেদিন অর্ডার দেন পরদিন তার ইমেইলে জানানো হয় অ্যামাজনের অর্ডারটি কমপ্লিট হয়নি। ইমেইলে একটি ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর মাহবুব ওই নম্বরে কল করেই ফেঁসে যান। মুহূর্তেই তার ইমেইলটি হ্যাক হয়ে যায়। পরদিন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট লগইন করে দেখতে পান, তার অ্যাকাউন্ট থেকে ৯৫০ ডলার উধাও। অভিযোগ দেওয়ার পর ডলার ফেরত পেয়েছেন। কিন্তু এ ঘটনার তদন্ত চলছে।

সিরাজুল ইসলাম নামে অপর এক বাংলাদেশি প্রবাসী গণমাধ্যমকে বলেন, আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী চেজ ব্যাংকে তার একটি চেকিং ও বিজনেস অ্যাকাউন্ট আছে। একদিন ঘুম থেকে উঠে নোটিফিকেশন পান যে তার বিজনেস অ্যাকাউন্টে ৫০ ডলারের একটি লেনদেন হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। অথচ তিনি সেখানে কখনোই যাননি। আর কোনো অর্থ বেহাত হয়েছে কিনা সন্দেহ হলে তিনি চোখ রাখেন আগের ট্রানজেকশনগুলোতে। এবার তিনি দেখতে পান বেশ কয়েকবার তার অ্যাকাউন্ট থেকে ছোট ছোট অ্যামাউন্টের অর্থ বেহাত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এ ঘটনা তিনি ব্যাংকে ফোন করে জানান। প্রতিটি বেহাত লেনদেনের অর্থ ফেরত পাওয়া গেলেও ব্যাংক তার ডেবিট কার্ডটি পরিবর্তন করে দেয়। এরপর থেকে সতর্ক রয়েছেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে ছোট পরিমাণে অর্থ বেহাত হলেও অনেকেই তা খেয়াল করেন না। এটাই স্ক্যামারদের এক ধরনের কৌশল। এর আগে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক সিটিতে বসবাসরত চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার অহিদুল মাওলা নামে এক যুবকের প্রায় ২৫ হাজার ডলারের মতো অর্থ হ্যাকাররা হাতিয়ে নিয়ে যায়। অহিদ যুগান্তরকে বলেন, কিছুদিন আগে তার মোবাইলে অপরিচিত একটি কল আসে। কলটি রিসিভ করতেই কেটে যায়। পরদিন ওই নম্বর থেকে আরও দুই বার কল আসে। দুটি কলই একই ভাবে রিসিভ করতে গিয়ে কেটে যায়। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার সিমটি বিকল হয়ে আছে। এরপর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চেক করে দেখতে পান তার ২২ হাজার ডলার উধাও। বিষয়টি তিনি ব্যাংকে জানালে কর্তৃপক্ষ ১৬ হাজার ডলার ফেরত দিলেও এখনো ৬ হাজার ডলার ফেরত দেয়নি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে এই ৬ হাজার ডলার অহিদুলের ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে উত্তোলন করা হয়েছিল। যদিও অহিদুল জানান, তিনি কখনোই তার ডেবিট কার্ড ব্যবহার করেননি। জানা গেছে, হ্যাকরারা তার অ্যাকাউন্ট জব্দ করে ডেবিট কার্ডটি নিয়ে নেয়। এরপর হুবহু ওই কার্ড তৈরি করে এই ডলার উঠিয়ে নেয়। এ বিষয়ে অহিদুল আইনের আশ্রয় নেবেন বলেও জানান। একইভাবে নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে বসবাসরত নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুরের এক গ্রোসারি শপের মালিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ১৬ হাজার ডলার নিয়ে যায় স্ক্যামাররা। যদিও ওই ব্যবসায়ীর পুরো ডলারই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ফেরত দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, স্ক্যামাররা খুবই বিচক্ষণ ও মেধাসম্পন্ন। তারা বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য কেনাবেচা করে। ফোনের দোকান, মেডিকেল অফিস এবং বিভিন্ন থার্ড পার্টির কাছ থেকে একজন নাগরিকের তথ্য পাচার হচ্ছে। অনেক সময় তথ্য বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। টি-মোবাইলের মতো জায়ান্ট কোম্পানি গ্রাহকের তথ্যের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। এ পর্যন্ত ছয়বার তাদের তথ্যভান্ডারে হানা দিয়ে তছনছ করেছে হ্যাকাররা। এসব তথ্য জানান সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করা একজন পুলিশ কর্মকর্তা।

পুলিশ জানায়, শাহাদাত ইমনের অর্থ হ্যাকের তদন্ত করতে গিয়ে তারা জেনেছেন হ্যাকরারা প্রথমে তার সিম তুলে নিয়েছিল। এরপর ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট দখলে নিয়ে তার গচ্ছিত ডলার তুলে নেয়। পুলিশ আরও জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো প্রিপেইড মোবাইল ফোনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। কথা বলার তিনটি নম্বর বলতে পারলেই সিম রিপ্লেস করে দেয় কোম্পানিগুলো। এর বাইরে তাদের আর কোনো নিরাপত্তা প্রশ্ন থাকে না। প্রবাসী ইমনের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। তিনটি নম্বর থেকে ১৩ বার কল রিসিভ করা মানে তিনটি নম্বরে তিনি কথা বলেছেন। এভাবে সহজেই তার সিম নিয়ে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ডে ঢুকে পড়ে স্ক্যামাররা।

সাধারণত প্রতি বছর ট্যাক্স রিটার্ন মৌসুম শুরু হলে স্ক্যামারদের তৎপরতা বেড়ে যায়। তারা নাগরিকের ট্যাক্স রিটার্নের অর্থ হাতিয়ে নিতে তাদের তথ্য সংগ্রহ করে। এমনকি আইআরএসের অ্যাকাউন্ড হ্যাকড করে রিটার্নের জন্য যে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দেওয়া হয় তার পরিবর্তন করে দেয় স্ক্যামাররা। এভাবে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে স্ক্যামাররা।

ট্যাক্স রিটার্ন মৌসুমে স্ক্যামাররা ট্যাক্স ফাইলিংয়ের পর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য চুরি করার জন্য নানাভাবে ওতপেতে থাকে। ফলে ট্যাক্স ফাইলিংয়ের পর ফোনে এ সংক্রান্ত যোগাযোগ না করার পরামর্শ দিচ্ছে ট্যাক্স ফাইল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। স্ক্যামের শিকার ভুক্তভোগী এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, স্ক্যামাররা অত্যন্ত সংঘবদ্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো-এসব স্ক্যামের সঙ্গে অনেক বাংলাদেশির নাম এসেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ সংক্রান্ত কিছু প্রমাণও পেয়েছে। তাদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে স্ক্যামাররা। স্ক্যামে জড়িতদের মধ্যে ফিলিপিনো ও ভারতীয়দের নাম সবার আগে উঠে আসছে। এরপর রয়েছে পাকিস্তানিদের নাম। স্ক্যামিংয়ের সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশিদের নামও আসছে। এসব বাংলাদেশিরা নানাভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীদের তথ্য সংগ্রহ করে তা সরবরাহ করছে পেশাদার স্ক্যামারদের হাতে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল তদন্তে বেশকিছু বাংলাদেশির নাম এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশন (এফসিসি) টেলিফোন স্ক্যামের বেশকিছু ঘটনা তদন্ত করছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category