• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৮:৩৬ অপরাহ্ন

রাষ্ট্রের অন্যতম স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের খেই হারানো দেশের জন্য সুখকর নয়।

Reporter Name / ২৭ Time View
Update : বুধবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৩

-রিন্টু আনোয়ার
কপাল কুণ্ডুলার মতো ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো’-প্রশ্নের মুখে এখন নির্বাচন কমিশন-ইসি। কিছু কাজ ও কথাবার্তায় নিজেদের দিকে প্রশ্নগুলো টেনে এনে বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন কমিশন(ইসি)। একবার বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে ইসি কোনো চাপে নেই। কারণ এটি সরকার থেকে সরকার বা জি টু জি বিষয়। নির্বাচন কমিশনের বিষয় নয়। সম্প্রতি আবার বললেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের চাপ পড়েছে বর্তমান কমিশনের ওপর। এর আগে ইসি কথা দিয়েছে, এবার আর রাতে ভোট হবে না; দিনের ভোট দিনেই হবে।  হালনাগাদ তাদের নতুন কথা: এক শতাংশ ভোট পড়লেই নির্বাচন আইনগতভাবে বৈধ। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়ে এ ধরনের কথা শোনানো দরকার হচ্ছে কেন নির্বাচন কমিশনের?
তবে,বর্তমান নির্বাচন কমিশন কোন হালে বা দশায় আছে, তা বুঝতে শেরে বাংলা নগরে নির্বাচন কমিশন অফিসে গিয়ে আড়ি বা কান পাততে হয় না। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ তার সহকর্মী কমিশনার ও সচিবের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য খেয়াল করে শোনাই যথেষ্ট। তারা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বার্তা দিচ্ছেন। এতে ভালো রকমের তথ্য জোগান হচ্ছে।
এ পর্যায়ে এসে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সম্প্রতি জানালেন, এক শতাংশ ভোট পড়লেই নির্বাচন আইনগতভাবে সঠিক, বৈধ। এটিই যদি খাস কথা হবে বা নিয়মের কতা হয়,তাহলে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক- প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করা নিয়ে এতো কথা কেন? এক শতাংশ ভোট পড়লেই  নির্বাচন বৈধ হয়ে গেলে ভোট করারই বা কী দরকার? এমন অভাবের দিনে ভোটের নামে রাষ্ট্রের এতা টাকা নষ্টেরই বা কী দরকার? নাকি তাপে-চাপে খেই হারিয়ে একেক সময় এ ধরনের একেক কথা বেরিয়ে পড়ছে তাদের মুখ ফসকে?
সিইসির এক শতাংশ ভোটের কথাটির আগে-পিছে আরো কিছু কথা ছিল। তিনি বলেছেন, দেশে যদি ১ শতাংশ ভোট পড়ে, ৯৯ শতাংশ না পড়ে লিগ্যালি দ্যাট ইজ রাইট। বৈধতার প্রশ্ন উঠতে পারে। বাট দ্য কোয়েশ্চেইন অব লিগ্যালিটি উইল নট অ্যারাইজ। সো দেয়ার ইজ এ কনফ্লিক্ট বিটুইন লিগ্যালিটি অ্যান্ড লেজিটিমেসি। আমরা লেজিটিমেসি নিয়ে মাথা ঘামাবো না। তার কথা কিন্তু পরিস্কার। এটি নতুন কথাও নয়। তার ২০১৪ বা ১৮ সালের পূর্বসরি সিইসিরাও লেজিটিমেসি নিয়ে পরোয়া করেননি। অর্থাৎ বিনাভোটে ১৫৪ জনের এমপি হয়ে যাওয়া বা রাতে ভোট করে ফেলার লেজিটিমেসি নিয়ে প্রশ্ন করা অবান্তর। ওই নির্বাচন গুলোও লিগ্যালি বৈধ। প্রশ্নটা এখন ভিন্ন জায়গায়। সামনে তা হলে কোন ধরনের লেজিটটিমেসিলেস নির্বাচন আসছে? বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে সেই ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত সব সরকারের সব নির্বাচনেরই বৈধতা প্রতিষ্ঠিত। সেই বিচেনায় সামনেরটিও বৈধ হতে বাধা কোথায়! এটাও গ্রহণযোগ্যই হবে। আগের রাতে কেন দুতিন আগে থেকেই বাক্সভর্তি রাখলেও আইনগতভাবে সমস্যা হবে না। ১৫৪ জন কেন প্রায় তিন’শ আসনে বিনাভোটে এমপি হয়ে গেলেও সমস্যা হবে না। কারণ যারা এটা পরিচালনা করবেন তারাতো মাত্র এক শতাংশ ভোট পড়লেও নির্বাচন বৈধ হবে বলে জানান দিয়েই দিয়েছেন।
প্রচলিত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী, আগামী ২৯ জানুয়ারি’২৪ তারিখের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতেই হবে। ক্ষমতাসীনরা যেকোনো মূল্যে এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন সম্পূর্ণ করার বা তুলে আনার  ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। নির্বাচন কমিশনও তাই তৎপর। বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীরা ওই নির্বাচনে না এলেই বা কী? সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের যথাযথ পরিবেশ বিরাজ করছে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানা প্রশ্ন উঠলেই বা কী? ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউসহ বিভিন্ন দেশ নির্বাচন পর্যবেক্ষক না পাঠলেও কিছু যাবে আসবে না। রেজিটিমেসি নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠবে, কিন্তু এটা আইনত বৈধ হয়ে যাবে। নির্বাচন কমিশন লেজিটিমেসি নিয়ে যে, মাথা ঘামাবে না- তা তারা খোলাসা করে জানিয়েই দিচ্ছেন প্রতি নিয়ত।
দৃশ্যত ইইউর পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণার পরও ক্ষমতাসীনরা বরাবরের মতো ডেমকেয়ার। উপরন্ত বিদেশীদের সাথে তলে তলে সমঝোতা হয়ে গেছে বলে বার্তাও দিচ্ছে। তাদের এই মানসিকতা আত্মঘাতী হয় কিনা-এ প্রশ্ন থাকলেও তা গ্রাহ্য না করার একটি মহল তৈরি হয়েছে। তারা মানতেই চাচ্ছেন না, ভোটাধিকার আন্তর্জাতিক আইন ও অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা স্বীকৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার বিষয়, এটি কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। তারা এও অনুধাবন করতে নারাজ যে হুট করে যুক্তরাষ্ট্র কারও বিরুদ্ধে ভিসানীতি প্রয়োগ করেনি। দালিলিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তথ্য-প্রমাণ ছাড়া তাদের কিছু করার সুযোগ নেই। অর্থাৎ যেসব নির্বাচনী কর্মকর্তা, বিচারক, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা গত নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার হরণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন,তাদের অনেকেইসহ নতুন দায়িত্ব প্রাপ্তরা এবারও তা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন এবং অন্যদের তা করার জন্য প্ররোচিত করছেন, কিন্তু আগের প্রেক্ষাপট আর বর্তমান প্রেক্ষাপট যে এক নয় সেটা তারা বুজেও না বুঝার ভান ধরছেন, অথচ তাদের পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসছে।
দেশের বৃহত্তর বিরোধী অংশ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে দেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণের এবং যেকোনো উপায়ে একটি একতরফা,বিতর্কিত নির্বাচন প্রতিহত করার যে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, তা তারা উপলব্ধি করতে পারছেন না, নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই প্রথমবারের মতো ভিসা নীতি প্রয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ‘টেস্ট কেস’। যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধাদানকারীদের জন্য একধরনের সতর্কবার্তা। ভোট জালিয়াতি থেকে শুরু করে ভোটের প্রক্রিয়াকে বাধাদানকারী যে কেউ এই নীতির আওতায় পড়তে পারেন। শুধু তা–ই নয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কলুষিত করার প্রয়াসে অতীতে যারা লিপ্ত ছিলেন বা ভবিষ্যতেও থাকবেন, তাদের বিরুদ্ধেও এই ভিসা নীতি কার্যকর থাকবে। মোটকথা সামনের নির্বাচন এযাবৎ অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হতে যাচ্ছে। এর ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব সর্বপ্রথম নির্বাচন কমিশন ও কর্মকর্তাদের ওপরে বর্তাবে। অতীতে দায়িত্ব না নিয়ে কমিশন পার পেলেও ভবিষ্যতে তা না–ও হতে পারে। লিগ্যালিটি এবং লেজিটিমেসির জ্ঞান সামনে কাজে নাও লাগতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র,কানাডা,অষ্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার ব্যাপারে ব্যাপক চাপ রয়েছে। ভৌগলিক, ভূ-রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, রাশিয়া, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশেরই চোখ বাংলাদেশের ২৪ সালের নির্বাচনের দিকে। সেখানে যোগ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতির ঘোষণার বিষয়। আফ্রিকার কয়েকটি দেশের ওপর নির্বাচন প্রশ্নে এ ধরনের ভিসা নীতি আরোপ করা হলেও তা করা হয়েছে নির্বাচনের পর। ফলে এই নীতি তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ফলে,বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা করা হয়েছে নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরুর আগেই।
অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। সেখানেই এখন দুঃকজনক খেই হারানো ভাব। তাও  প্রকাশ্যে। তারওপর তাদের কিছু ক্ষমতা নির্বাচনের ঢের আগেই কতল করে নেয়া হয়েছে। জাতীয় সংসদে আরপিও সংশোধনী আইন পাসের মাধ্যমে পরাধীন ইসিকে আরও পরাধীন করার কাজটি সাঙ্গ করেছে বর্তমান সরকার। নির্বাচন কমিশন এতে আপত্তি করেনি, শরমও পায়নি। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১ (এ) উপধারায় ছিল, নির্বাচন কমিশন যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত ও আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে। সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী, ভোট গ্রহণের আগে ইসি চাইলেও এখন আর নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে না। এ ছাড়া রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও পুরো আসনের ফলাফল স্থগিত বা ভোট বাতিল করতে পারবে না ইসি; শুধু যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ থাকবে, সেসব কেন্দ্রের ফলাফল চাইলে স্থগিত করতে পারবে। এই অক্ষমতার জেরে কমিশনের এখন একেক সময় একেক কথা বলা ছাড়া গতি নেই। আবার খেই হারানোর কথা স্বীকারের জোও নেই। কিন্তু, বিগত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের চাপ বইতে হচ্ছে তা মালুম করতে হচ্ছে। তামাদি চাপের সঙ্গে সামনে যে আরো চাপ-তাপসহ কতো কী অপেক্ষা করছে তা বোঝার পর্বে যাচ্ছে না কমিশন।
পরিশেষে বলতে চাই, নির্বাচন কমিশনের নানাবিধ অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত, কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিনিয়তই নাগরিক সমাজ থেকে যে ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য উটে আসছে তা রাষ্ট্রের একটি অন্যতম স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের জন্য সুখকর নয়। বেশির ভাগ সময় এর জন্য দায়ী খোদ বর্তমান নির্বাচন কমিশন। হয়তো তারা ভুলে গেছে যে নির্বাচন কমিশন জনগণের কাছে, বিশেষ করে ভোটার এবং রাজনৈতিক দলের এবং গণতান্ত্রিক সমাজের কাছে দায়বদ্ধ। কাজেই তাদের কর্মকাণ্ড জনগণের নজরদারিতে থাকবেই। সে কারণেই বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনকে স্বচ্ছ হতেই হবে।
লেখক ঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category