• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০৮ পূর্বাহ্ন

‘‌অগ্নিকাণ্ডের দায় তদারকি সংস্থা এড়াতে পারে না’

Reporter Name / ২১৩ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০২৩

মেজর (অব.) একেএম শাকিল নেওয়াজ ২০১৩-১৯ সাল পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স) ছিলেন। ১৯৯২ সালে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন তিনি। ২০২০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া এ মেজর কমান্ডো, গোয়েন্দা ও ফায়ার ফাইটার হিসেবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন শাকিল নেওয়াজ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেছেন। ফেলোশিপ করেছেন এশিয়া প্যাসিফিক সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজ থেকে। শাকিল নেওয়াজের জন্ম ১৯৭১ সালে, টাঙ্গাইলে।

প্রশ্ন: বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে ৬ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগার কারণ কী?

শাকিল নেওয়াজ: বঙ্গবাজারের অবকাঠামো পুরোপুরি নন ইঞ্জিনিয়ারিং। প্রকৌশলগতভাবে বিবেচনায় নিলে এ ধরনের স্থাপনা আধুনিক নগরীতে থাকার কথা নয়। যে কোনো শপিং মলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকার কথা। বঙ্গবাজারে সেই ব্যবস্থা তো দূরের কথা; পানি পর্যন্ত মজুত ছিল না। এ ছাড়া সিল্ক, প্লাস্টিক, সুতা, কম্বল, শার্ট-প্যান্ট তুলনামূলক তাড়াতাড়ি জ্বলে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে যায়। ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় বেশি লাগতে পারে। বাতাসের গতি ছিল ৪০-৫০ কিলোমিটার। সময়ে সময়ে এ গতির পরিবর্তন হচ্ছিল। ফলে আগুন ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য আবহাওয়া অনুকূলে ছিল। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই ফায়ার সার্ভিস অভিযান পরিচালনা করেছে। মার্কেটটি আগুনে পোড়ার পর টিনের চালা ভেঙে পড়ছিল। টিনের নিচে জ্বলতে থাকা কাপড়ের আগুনে পানি পৌঁছানো জটিল ছিল। সহজ করে বললে, ৫ ফুট আগুনের স্তূপে ওপরের ১ ফুট পর্যন্ত পানি ঢেলে আগুন নেভানো যায় না। গভীর পর্যন্ত পানি পৌঁছাতে হবে।

প্রশ্ন: উদ্ধারকাজ ব্যাহত হওয়ার জন্য উৎসুক জনতার ভিড়কে দায়ী করেছে ফায়ার সার্ভিস।

শাকিল নেওয়াজ: প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার পাশাপাশি মানবসৃষ্ট প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে গিয়ে বারবার উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু এর সমাধান হচ্ছে না। বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময়ও উৎসুক জনতার ভিড়ে কাজ করা যাচ্ছিল না। সেই একই অবস্থা পরবর্তী দুর্ঘটনার সময়ও দেখা গেছে। এমনকি বঙ্গবাজারে এটি আরও ব্যাপকতা পেয়েছে। এর সুরাহা করা দরকার। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধারকাজ চালান। যেসব লোক তাঁদের ওপর আক্রমণ করল; ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তরে হামলা চালালো; তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। ১০-১২টি গাড়ি আর কোনোদিন আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার করে যাবে না। এসব গাড়ি যারা ভাঙচুর করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করল, তারা কেমন মানসিকতার পরিচয় দিল? উৎসুক জনতা সেলফি তুলে, ভিডিও করে কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাশাপাশি একটি চক্র মার্কেটের মালপত্র চুরিও করেছে। উৎসুক জনতা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পুলিশ ও র‍্যাবের। তাদের সঙ্গে দরকার হলে বিজিবি, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। ফায়ার সার্ভিসকে কাজের পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গেও অশালীন আচরণ করেছে, তাদেরও চিহ্নিত করা দরকার।

প্রশ্ন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুর থেকে পানি আনা না গেলে ভয়াবহতা কেমন হতো?

শাকিল নেওয়াজ: আগেই বলেছি, সব মার্কেট ও শপিং মলে আগুন নেভানোর জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পানি থাকার কথা। বঙ্গবাজারে তা না থাকায় ওয়াসা থেকে সংযোগ নিতে হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে দূরের শহীদুল্লাহ হলের পুকুর থেকে মোটরের মাধ্যমে পাইপ দিয়ে পানি নিতে হয়েছে। এত দূর থেকে পানি নিতে গেলে পানির গতি কমে যায়। পথে লোকজন পাইপ টানাটানি করে। পাইপে ছিদ্র থাকলে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ব্যাহত হয়। এর পরও শহীদুল্লাহ হলে পুকুর ছিল বলে কিছুটা রক্ষা হয়েছে। পুলিশ সদরদপ্তরের সামনের পার্কে একটি পুকুর ছিল, তা ভরাট করে ফেলা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে জলাশয়ের প্রয়োজনীয়তা বঙ্গবাজারের দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আগুন লাগলে আশপাশের কোন উৎস থেকে পানি নেওয়া হবে, তা ফায়ার সার্ভিস আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখে। ঢাকা নগরীতে জলাশয় যেভাবে ভরাট হচ্ছে, তা ভবিষ্যতে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করতে পারে।

প্রশ্ন: ঢাকার আশপাশের নদনদী ভরাটের পাশাপাশি মফস্বল শহরেও পুকুর-দিঘি ভরাট করা হচ্ছে।

শাকিল নেওয়াজ: হ্যাঁ। ঢাকার অদূরে টঙ্গী ও গাজীপুরে অনেক শিল্পকারখানা রয়েছে। এসব এলাকায় ১০ থেকে ২০ তলাবিশিষ্ট সুউচ্চ ভবন তৈরি হয়েছে। এখানে আগুন লাগলে পানির উৎস হিসেবে মূলত পুকুর, খাল, নদীকেই বেছে নিতে হবে। কিন্তু যেভাবে জলাশয় ভরাট করে আবাসন হচ্ছে, তাতে আমরা শঙ্কিত। আমি নগরায়ণের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু সেই নগরায়ণ হতে হবে পরিবেশসম্মত। গাছপালা, পাখি, জলাশয় প্রভৃতি নিয়েই তো পরিবেশ। শরীরের একটি অঙ্গে জটিলতা হলে যেমন পুরো শরীর অসুস্থ হয়ে যায়; একটি পরিবেশের একটি উপাদান বাদ দিলে সেখানে ঝুঁকি আসবেই। পরিবেশবিদরা আন্দোলন করছেন। জানি না, তাঁদের আওয়াজ নীতিনির্ধারকরা আমলে নিচ্ছেন কিনা! আইন করে জলাশয় ভরাট বন্ধের পাশাপাশি পর্যাপ্ত জলাশয় তৈরি করতে হবে।

প্রশ্ন: ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, অভিযানের শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের গাফিলতি ছিল।

শাকিল নেওয়াজ: অভিযোগ আসতেই পারে। বাস্তবতা স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে বের করে আনা যেতে পারে। এখানে ফায়ারের পাশাপাশি রসায়নবিদ থাকতে পারেন। কারণ, আগুনের উৎস বের করতে রসায়নবিদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ধ্বংস্তূপের মধ্যে যদি কোনো ধরনের দাহ্য পদার্থের আলামত পাওয়া যায়, তাহলে বিষয়টি অন্যদিকে মোড় নেবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছাড়া খুঁটিনাটি বিষয় বের করে আনা সম্ভব নয়। উদ্ধারকারী সংস্থার বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ করার মানে হয় না। তবে উদ্ধারকারী দল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কৌশল আঁকতে ভুল করেছিলেন কিনা, তা তদন্ত করে দেখা যেতে পারে।

প্রশ্ন: ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, পুলিশ সদরদপ্তর রক্ষা করতে গিয়ে মার্কেটের দিকে মনোযোগ কম ছিল।

শাকিল নেওয়াজ: আমার মনে হয় না। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া এসব কথায় কান দেওয়ার যৌক্তিকতা নেই। বঙ্গবাজারের আগুন আশপাশের মার্কেটে ছড়িয়েছে। এ দায় ওইসব মার্কেট কর্তৃপক্ষকেও নিতে হবে। কারণ, তাঁদের প্রতিষ্ঠানেও ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম ছিল না। তাঁরা ব্যবসা করছেন, টাকা রোজগার করছেন; অথচ নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম নিশ্চিত করছেন না। গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা না রেখেই মার্কেট নির্মিত হচ্ছে। এসব অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে যারা ঋণ দিচ্ছে; সেসব ব্যাংক ও বীমা দায় এড়াতে পারে না। মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে ১৬-৩০ শতাংশ সুদে ঋণ নিচ্ছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। অগ্নিকাণ্ডে যাঁরা সর্বস্ব হারিয়েছেন, তাঁরা বোঝেন এ ঋণের যন্ত্রণা কত কঠিন। অনিরাপদ স্থানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ নিরুৎসাহিত করতে পারে। কিন্তু কতিপয় দালালের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে লাভের সিংহভাগ সুদ-আসলে মধ্যস্বত্বভোগী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দিচ্ছে। তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানও দায় এড়াতে পারে না।

প্রশ্ন: বঙ্গবাজারের মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ২০১৯ সালে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। এর পর কেন আর তৎপরতা দেখা গেল না?

শাকিল নেওয়াজ: এ প্রশ্ন আমারও। ৪ বছরে ১০ বার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস মার্কেটটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করে সিটি করপোরেশনে চিঠি দিয়েছে। মার্কেটের সামনে নোটিশ টানানো হয়েছিল। এর পরও কেন ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটটি বন্ধ বা সংস্কার করা যায়নি? ২০১৯ সালের পর এতদিন পর্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা চালাতে দেওয়ার দায় তদারকি প্রতিষ্ঠান এড়াতে পারে না। জবাবদিহি নিশ্চিত করা না গেলে দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে না। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর মানসিকতা বিপদ ডেকে আনে।

প্রশ্ন: ফায়ার সার্ভিস সদরদপ্তরের পাশের মার্কেটে যে ভয়াবহতা দেখা গেল; দূরের মার্কেট বা আবাসিক ভবন এ থেকে কী ধরনের বার্তা পেতে পারে?

শাকিল নেওয়াজ: আগুন ছড়িয়ে গেলে ঘটনাস্থল কাছাকাছি হলেও লাভ হয় না। ফায়ার সার্ভিস খবর পাওয়ামাত্র অভিযানে নেমেছে। ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। আগেই বলেছি, পোশাকের দোকান হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। এ ছাড়া প্রথম যে ব্যক্তি আগুন দেখেছেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে খবর দিয়েছেন কিনা, তা খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ ব্যবসায়ীরা ফায়ার সার্ভিসকে দেরিতে খবর দিয়ে মালপত্র সরানো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন কিনা, তা-ও দেখতে হবে।

প্রশ্ন: হেলিকপ্টার দিয়ে পানি ঢাললে বাতাসে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে কী?

শাকিল নেওয়াজ: পৃথিবীতে আর কোথাও দেখেছেন– হেলিকপ্টার দিয়ে পানি ঢেলে আগুন নেভানো হয়? আমি বিদেশে একাধিক প্রশিক্ষণ নিয়েছি। কোথাও দেখিনি। হ্যাঁ, যদি জঙ্গলে আগুন লাগে তাহলে হেলিকপ্টার দিয়ে পানি ঢালা হয়। কিন্তু আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবনে আগুন লাগলে হেলিকপ্টার ব্যবহার করলে ক্ষতি হয়। হেলিকপ্টারের পাখা বাতাসের তীব্রতা বাড়িয়ে দহনে সহায়তা করে। ৪০-৫০ কিলোমিটার বেগে বাতাস; সেখানে ওপর থেকে পানি ফেললে লক্ষ্যবস্তুতে পড়ার কথা নয়। বনানীর এফআর টাওয়ারে প্রথমে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছিল। পরে ভুল বুঝতে পেরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে হেলিকপ্টার ব্যবহার আসলে অপব্যবহার। এসব কারণে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।

প্রশ্ন: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

শাকিল নেওয়াজ: আপনাদের জন্য শুভকামনা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category