ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অবৈধ বাংলাদেশি মুসলিমদের জন্য কোনো সুখবর নয়। আগামী চার বছর তাদের সুখবরের বদলে আতঙ্কেই দিন কাটাতে হবে বলে মতামত দিয়েছেন বাংলাদেশি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
তিনি প্রেসিডেন্ট পদে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হবার পর যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বৃহত্তম অভিবাসী প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার ঘোষণা দেন। বাংলাদেশি পর্যবেক্ষকদের মতে- ট্রাম্পের অভিবাসী প্রত্যাবাসনের ঘোষণায় বাংলাদেশি মুসলিমদের জন্য কিছুটা হলেও প্রভাব পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি এলাকার বাংলাদেশি অভিবাসী আইনজীবী মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, বাংলাদেশি মুসলিমদের জন্য ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া কোনো সুখবর নয়। তিনি মুসলিমবিরোধী এবং অভিবাসীবিরোধী। যারা মামলায় হেরেও বছরের পর বছর এখানে বসবাস করছেন তাদের জন্য হবে দুঃস্বপ্ন। ট্রাম্পের অভিবাসন নীতিগুলো সমস্ত অভিবাসীদের জন্য খুব কঠোর এবং কঠিন হবে। তবে ছোট ব্যবসার পাশাপাশি উচ্চআয়ের পরিবারের জন্য ভালো হবে।
কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী ড. গোলাম চৌধুরী ইকবাল বলেন, ট্রাম্পের পুনরায় প্রেসিডেন্ট হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। তার অভিবাসন নীতির কড়াকড়ির কারণে গ্রিন কার্ড, ভিসা প্রক্রিয়া এবং অভিবাসীদের আইনি মর্যাদায় জটিলতা বাড়তে পারে। সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় ট্রাম্প প্রশাসনের আগের ব্যর্থতার নজির রয়েছে; যা বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করতে পারে। এছাড়াও মার্কিন প্রশাসনে ভারতীয় লবির শক্তিশালী অবস্থানের কারণে বাংলাদেশি স্বার্থে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন, কিছু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণে ‘প্যাথলজিক্যাল নার্সিসিজম’ বা বিপজ্জনক ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্যের লক্ষণ রয়েছে। ট্রাম্পের এই বৈশিষ্ট্য বিশ্ব রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে, যা অভিবাসীদের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে উল্লেখ করেন ড. গোলাম।
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তারিক হাসান বলেন, অভিবাসীদের অনুপস্থিতির বড় প্রভাব পড়বে মার্কিন অর্থনীতিতে। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, যদি অভিবাসীদের পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে ধরে নিন মাথাপিছু জিডিপি পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ কমে যাবে। অর্থাৎ কিছু মানুষ কমে যাওয়ার (অভিবাসীদের অনুপস্থিতি) যে প্রভাব, তার প্রতিফলন ঘটবে জিডিপিতে।
তার গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তারিক হাসান বলেছেন, অভিবাসন উদ্ভাবনী শক্তিতে ইন্ধন জোগায়, উৎপাদনশীলতা বাড়ায় এবং এটা কিন্তু শুধুমাত্র কোনো একটা বিশেষ সেক্টরেই সীমাবদ্ধ নয়।
প্রসঙ্গত অভিবাসীরা তুলনামূলকভাবে কম বয়সি এবং তাদের কাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল সেক্টরে কর্মরত তিন কোটি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ১৯ শতাংশই অভিবাসী।
মার্কিন সরকারি সংস্থা ‘ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিক্স’-এর তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমশক্তিতে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে অভিবাসীদের হার আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি।
কংগ্রেসনাল বাজেট অফিসের অনুমান অনুযায়ী, ২০২২ থেকে ২০৩৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আসা ১৬ বছর বা তার বেশি বয়সি অভিবাসীদের প্রায় ৯১ শতাংশের বয়স ৫৫ বছরের কম হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রে বয়স্কদের মোট জনসংখ্যার ৬২ শতাংশ। অর্থ ব্যবস্থা ভূমিকা পালন করে এমন সেক্টর যেমন কৃষি- সম্পূর্ণরূপে অভিবাসী শ্রমিকদের উপর নির্ভরশীল।
মার্কিন শ্রম মন্ত্রণালয়ের জাতীয় কৃষি শ্রমিক জরিপ অনুযায়ী, ৭০ শতাংশ শ্রমিক অভিবাসী। যদিও এদের মধ্যে অনেক শ্রমিকের কাছে এখনো পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট নথিপত্র নেই।
আমেরিকান ইমিগ্র্যান্ট কাউন্সিলের (এআইসি) গবেষণা নির্দেশকের দায়িত্বে রয়েছেন নান ব্যু। তিনি অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটা সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন। তার মতে, অভিবাসীদের সরিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো কৃষিকাজ করা, ফল এবং শাকসবজি তোলা আর উৎসবের মৌসুমে ক্রমবর্ধমান বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক পাবেন না ক্ষেতের মালিকরা।
অন্যদিকে যারা অভিবাসনের সমালোচনা করেন, তাদের একটা যুক্তি হলো, বিদেশ থেকে আসা বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কম মজুরিতে কাজ করতে প্রস্তুত এবং এর ফলে মার্কিন নাগরিকরাও কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন আর ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ২০১৪ সালে অর্থনীতিতে অভিবাসনের প্রভাব নিয়ে ২৭টি গবেষণার পর্যালোচনা করেছে। এ পর্যবেক্ষণ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী নাগরিকদের বেতনের ওপর অভিবাসনের গড় প্রভাব প্রায় শূন্যের সমান।
সাম্প্রতিক সময়ে ইস্টার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে একটা গবেষণা করা হয়েছে। সেই গবেষণা বলছে, অভিবাসীর সংখ্যা বাড়লে তা মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যদিও পরিসংখ্যানের দিক থেকে তা একেবারে ক্ষুদ্র।
নিউইয়র্কের মূলধারার রাজনীতিবিদ ব্যবসায়ী ও বিএনপি নেতা গিয়াস আহমেদ বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশি তথা মুসলিম কমিউনিটি এবারের নির্বাচনে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। বেশির ভাগ বাংলাদেশি এবং অন্যান্য মুসলিম কমিউনিটি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে। মুসলিম কমিউনিটি ঐক্যবদ্ধভাবে ভোট প্রদান করে এবারে সর্বপ্রথম তাদের শক্তি প্রদর্শন করেছে; যা ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনি বিজয়ী ভাষণে উল্লেখ করেছেন। এই প্রথম আমেরিকার ইতিহাসে কোনো প্রেসিডেন্ট মুসলিম ভোটের কথা স্বীকার করে বক্তব্য দেন। এবার যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমদের স্লোগান ছিল ‘মুসলিম ভোট ম্যাটারস’। ইসরাইল কর্তৃক গাজায় গণহত্যার জন্য তিনি জো বাইডেন প্রশাসনকে দায়ী করেন। তাই এবার মুসলিম ভোট কমলা হ্যারিসের দিকে যায়নি।
গিয়াস আহমেদ বলেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন ইসরাইল কর্তৃক গণহত্যার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন তখন জো বাইডেনের প্রশাসন তাদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের পূর্বের ট্রাম্প আর নির্বাচনের পরের ট্রাম্প এক নয়। তিনি এখন সবার প্রেসিডেন্ট। তার বিজয় ভাষণেও তা পরিলক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশিদের কোনো ভয়ের কারণ নেই। তবে সীমান্ত সিলগালার প্রয়োজন আছে। হাজার হাজার মানুষ সীমান্ত দিয়ে আমেরিকায় প্রবেশ করছে প্রতিদিন। ডেমোক্রেটিক দলের শাসনামলে প্রতিদিন মানুষ ডিপোর্ট হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে ডিপোর্টেশন আদেশ রয়েছে তাদের সতর্ক থাকতে হবে উল্লেখ করেন গিয়াস।
বিএনপি নেতা জিল্লুর রহমান জিলু বলেন, যাদের ইমিগ্রেশন সমস্যা রয়েছে তারা বেকায়দায় পড়বে। যারা বৈধ হয়নি তাদের হয়তো ডিপোর্ট করতে পারেন ট্রাম্প প্রশাসন। আর হোমকেয়ার ব্যবসায়ীরা অনেকই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। সাধারণভাবে সব ব্যবসায়ী উপকৃত হবে।
এবারের ট্রাম্প আগের চেয়ে ভিন্নভাবে চলবেন। যেহেতু বয়সের কারণে এটাই তার শেষ প্রেসিডেন্সি এবং তিনি একটা বিশাল ম্যান্ডেট নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন তাই তিনি সবাইকে খুশি করেই তার নাম জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে লিখে রেখে যাবেন। এই আলোকে সাধারণভাবে সব বাংলাদেশি আমেরিকানরাও উপকৃত হবেন। বাংলাদেশের বিষয়ে তিনি একটি নির্বাচিত সরকারের বিষয়ে চাপ দেবেন যেটা বিএনপির জন্য পজিটিভ হবে বলে মন্তব্য করেন জিলু।
নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট নাসির খান পল বলেন, বাংলাদেশি হিসেবে বিশেষ কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে বাংলাদেশি আমেরিকান হিসেবে অবশ্যই অনেক কিছুতেই প্রভাব পড়বে। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে আমেরিকার যা যা সুবিধা হবে তার সুফল আমরা সবাই ভোগ করব। যুদ্ধের অবসান হবে, ইকোনমি অনেক ভালো হবে, বর্ডার বন্ধ হলে আইনের শাসনের উন্নতি হবে, ৩য় বিশ্ব যুদ্ধ থেকে আমরা বেঁচে যাব। আমরা বাংলাদেশিরা আমেরিকান হিসাবে অনেক কিছু সুফল ভোগ করব কিন্তু বাংলাদেশি হিসেবে মনে হয় না আলাদাভাবে আমাদের ওপর কিছু প্রভাব পড়বে।
নিউইয়র্ক প্রবাসী বিএনপি নেতা মোতাহার হোসেন বলেন, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত। এ রাষ্ট্র তার প্রতিষ্ঠানগুলো এত শক্তিশালী যেকোনো প্রেসিডেন্ট চাইলে এখানে কোনো ধরনের পরিবর্তন করতে পারেন না। আমেরিকা একটি ইমিগ্রেন্ট রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এখানে চাইলে যেকোনো নাগরিক তার অধিকার নিয়ে জীবনযাপন করতে পারেন। বৈধভাবে বসবাসকারী সব নাগরিকরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা পেয়ে থাকেন। তবে বৈধ কাগজপত্রহীনদের জন্য সমস্যা হতে পারে।
কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট ও নিউইয়র্ক প্রবাসী ব্যবসায়ী সৈয়দ আল আমিন রাসেল বলেন, আগের চাইতে আমেরিকার অর্থনীতি ভালোর দিকেই যাবে। বিশেষ করে রিটেল স্মল ব্যবসা যুদ্ধ বন্ধ করতে পারলে দ্রব্যমূল্য কমবে। তবে বৈধ কাগজপত্রহীনরা একটা ভীতির সময় পার করবেন। চাকরির বাজার আরও চাঙ্গা হবে যাতে যুবকরা উপকৃত হবে। বিশেষ করে অনেক বাংলাদেশি যুবক আইটি সেক্টরে আসছেন তাদের জন্য ভালো কিছু হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব বোঝার চেষ্টা করবেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি সত্যি। কারণ নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্পের একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টকে ঘিরে বিতর্ক জন্ম নেয়। ঢাকার সাবেক শাসনের সমর্থকরা আশা প্রকাশ করছেন যে, ট্রাম্পের বিজয় মার্কিন নীতিতে পরিবর্তন আনবে যা তাদের ক্ষমতায় ফিরে আসার পথ প্রশস্ত করবে।
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের তারিক হাসান বলেন, গত দুই দশকে অভিবাসন অনেক বেশি হয়েছে। যদিও অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অভিবাসন ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, তবে এর এমন কিছু দিক থাকতে পারে যা অন্যদের স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে বাধা দেয়। এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একটা বড় ইস্যু ছিল অভিবাসন। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস দুজনেই মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করা অভিবাসীদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলেন। ট্রাম্পকে বারবার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে দেখা গেছে, নথিবিহীন অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো হবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘উস্কানি’ দিয়েছিলেন এমন কথা বললেও কমলা হ্যারিস অবশ্য এ কথাও জানিয়েছিলেন যে, তিনি সীমান্ত নিরাপত্তা বিলের পক্ষে। এ বিলের আওতায় সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের জন্য শত শত কোটি ডলার বরাদ্দের বিষয়ে বলা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের ভূমিকা কী? যদি অভিবাসী না থাকে তাহলে তার কী প্রভাব পড়তে পারে দেশটিতে?
অভিবাসী না থাকলে আমেরিকার জনসংখ্যা অনেক কম হবে।
দেখা গেছে, ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিদেশি বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বেশি। সেই তথ্য বলছে, বিদেশে জন্মগ্রহণকারী চার কোটি ৭৮ লাখ মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেন; যা মোট মার্কিন জনসংখ্যার ১৪.৩ শতাংশ।
এ তালিকায় সবার প্রথমে রয়েছে মেক্সিকো থেকে আসা মানুষ। সেখানকার এক কোটি ছয় লাখ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। অন্যদিকে, সেখানে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা ২৮ লাখ এবং চীন থেকে আসা মানুষের সংখ্যা ২৫ লাখ।
প্রসঙ্গত, অভিবাসী কর্মচারীর সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণ হলেও যুক্তরাষ্ট্রে জন্মহার কমে যাওয়ার ফলে সেই দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩০-এর দশকের পর সর্বনিম্ন হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে। জন্মের হার ১৯৩০-এর দশকে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’-এর ফলে হ্রাস পেয়েছিল।
এর অর্থ হলো অন্যান্য অনেক দেশের মতোই যুক্তরাষ্ট্রও প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যার সঙ্গে লড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত খরচ। অন্যদিকে কাজকর্ম করতে সক্ষম অল্প বয়সি মানুষ কমে যাচ্ছে।
মার্কিন কংগ্রেসনাল বাজেট অফিস বলছে, ২০৪০ সালে মৃত্যুর সংখ্যা জন্মকে ছাপিয়ে যাবে। তখন অভিবাসনের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এই কারণে অনেক অর্থনীতিবিদ ও অভিবাসনপন্থি গোষ্ঠী দাবি জানিয়েছে, অর্থ ব্যবস্থার কথা মাথায় রেখে অভিবাসন দরকার, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে অভিবাসনের অনুমতি দেওয়া হোক।
দীর্ঘদিনের বাংলাদেশ পর্যবেক্ষক এবং মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অনুশীলনকারী হিসেবে জন ড্যানিলোভিজ জানিয়েছেন, ট্রাম্পের বিজয় অনেকের ভবিষ্যদ্বাণীর চেয়ে কম প্রভাব ফেলবে। প্রেসিডেন্ট অফিসে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করে অনেক বিশ্লেষক নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দিকে মনোনিবেশ করেছেন। তারা বিশ্বাস করেন, ট্রাম্প প্রশাসন বাইডেন প্রশাসনের মূল্যবোধের এজেন্ডা পরিত্যাগ করবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে প্রভাবিত করার জন্য ভারতকে অবাধ সুযোগ করে দেবে। আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ এই লোকেরাই বিশ্বাস করে এসেছে যে, বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বিদেশি শক্তির হাত ছিল। এই বিশ্লেষকদের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে তারা শেখ হাসিনার বিদায়ের নেপথ্যে দেশীয় কারণগুলোকে ক্রমাগত অস্বীকার করে গেছেন।
কোনো সন্দেহ নেই, মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির ধরন এবং উপাদান (এবং এর অনুশীলনকারীরা) পাল্টে যাবে যখন ট্রাম্প প্রশাসন জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণ করবে। অভিবাসন, ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের জন্য সমর্থন এবং বাণিজ্য নীতি প্রেসিডেন্টের প্রচারণার সময় সবচেয়ে বেশি মনোযোগ পেয়েছে। সাধারণভাবে ট্রাম্প বৈদেশিক নীতিতে কম হস্তক্ষেপ এবং ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতিতে বেশি আগ্রহ দেখিয়ে এসেছে। যে কেউ এ কথা বলতে পারে, বাংলাদেশ ট্রাম্পের প্রচারণার জন্য অগ্রাধিকার পেয়েছে বা ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর কিভাবে প্রভাব ফেলতে পারে তা বিবেচনা করার জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কিছুটা সময় নেওয়া উচিত।
ঢাকার জন্য সুসংবাদ হলো- তাদের কাছে এটি করার জন্য সময় আছে, কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে এবং বাংলাদেশে প্রভাব ফেলতে পারে- এমন নীতি পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়ন শুরু করতে সম্ভবত কয়েক মাস সময় লাগবে। এমনকি একটি রিপাবলিকান সিনেট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ট্রাম্প প্রশাসনের পূর্ণাঙ্গ পররাষ্ট্র নীতি তৈরি করতে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। অনেক চাপের ইস্যুর মাঝে বাংলাদেশ নীতি সম্ভবত ট্রাম্পের নতুন টিমের কাছে অগ্রাধিকার নাও পেতে পারে।
মার্কিন সম্পর্ককে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বিবেচনায় ঢাকার অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকার এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ কিভাবে এগুলোকে প্রভাবিত করে তা খতিয়ে দেখা উচিত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেমন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি দ্বারা পরিচালিত হবেন, তেমনি প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। হাসিনা পরবর্তী সময়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ম্যান্ডেট পরিবর্তন হয়নি। নিউইয়র্কের মিটিংয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, তারা এই এজেন্ডা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করতে প্রস্তুত। যুক্তরাষ্ট্র যে এই জোটের অংশ হতে চাইবে না তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শুধু সরকার থেকে সরকার বা প্রধান নির্বাহী থেকে প্রধান নির্বাহীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রসারিত। কংগ্রেসের সদস্য, বেসরকারি সংস্থা, সাংবাদিক এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অনেক বন্ধু রয়েছে। এগুলো সম্পর্কের স্থিতিশীলতার কারণ হিসেবে কাজ করবে। যদিও হাসিনা সরকার ভেবেছিল যে, ১৯৭১ সালের স্মৃতি উস্কে বা সাম্প্রতিক কথিত ষড়যন্ত্রের কথা বলে তারা লাভবান হবে, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের কেউ এরকম কিছু করবে এমন সম্ভাবনা খুব কম।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি প্রবাসীদের ওপর ক্রমবর্ধমান আস্থা। যাদের মধ্যে অনেকেই তাদের মাতৃভূমিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার অগ্রভাগে ছিলেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিষয়ক টিম, ওয়াশিংটনে একজন নতুন রাষ্ট্রদূতকে নিয়োগ করার মাধ্যমে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পথ প্রশস্ত করতে পারে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পর ট্রাম্পকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের উষ্ণ অভিনন্দন বার্তা ছিল এর প্রথম পদক্ষেপ। ঢাকায় যারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে চিন্তায় নিমজ্জিত, তাদের সবার প্রতি ‘শান্ত থাকুন এবং যেমন চলছে চলতে দিন’ বলে উপদেশ দেন জন ড্যানিলোভিজ।