• সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৪:৫৬ অপরাহ্ন
  • Bengali BN English EN

মাদকাসক্তির চিকিৎসা নিতে গিয়ে নির্যাতনে লাশ হন যুবক

Reporter Name / ৫৫ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ১ জুন, ২০২৩

ঘটনা তিন বছরের বেশি সময় আগের। ২০১৯ সালের ২৯ নভেম্বর বিকেল ৫টা। রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে ছুটে আসে একটি অ্যাম্বুলেন্স। ভেতরে এক ব্যক্তির নিথর দেহ। চিকিৎসকেরা জানালেন, হাসপাতালে আনার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সটি এসেছিল ঢাকার কেরানীগঞ্জের ‘সম্ভব’ মাদকাসক্ত চিকিৎসা সহায়তা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে।

ওই ব্যক্তির নাম সুজন সাহা (২৮)। তিনি সম্ভব মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি ছিলেন। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মামলা করেন তাঁর বোন গঙ্গা রানী সাহা। মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বলছে, পুনর্বাসন কেন্দ্রে নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছিল সুজনের। গত ডিসেম্বরে দুজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পিবিআই।

গঙ্গা রানী সাহার মামলায় আসামি করা হয়েছিল সুজনের ভাই খোকন সাহা ও তাঁর (খোকন) স্ত্রী ঝুমা রানী সাহাসহ মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে। সেখানে বলা হয়, সুজন মানসিক রোগী ছিলেন। পারিবারিক সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ করতেই তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছেন আসামিরা।

পিবিআই বলছে, সুজনের মৃত্যুর ১৫ দিন আগে ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর তাঁকে ওই মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করান খোকন সাহা ও ঝুমা রানী সাহা। সুজনের মৃত্যুর সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তাই অভিযোগপত্রে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগপত্রভুক্ত দুই আসামি হলেন, সম্ভব মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আরিফ হোসেন ও কর্মচারী আসিফ হোসেন।

পিবিআইয়ের আগে মামলাটি তদন্ত করেছিল কেরানীগঞ্জ থানা-পুলিশ। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের আরিফ হোসেন ও আসিফ হোসেনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেয় তারা। তবে খোকন সাহা ও তাঁর স্ত্রী ঝুমা রানী সাহার কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। এর বিরুদ্ধে বাদী গঙ্গা রানী সাহা আদালতে নারাজি দেন। পরে মামলাটি পুনর্তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পিবিআইকে।

পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে, সুজন সাহা মাদকাসক্ত হওয়ায় দীর্ঘ দিন ধরে মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। তিনি বড় ভাই খোকন সাহা ও তাঁর স্ত্রী ঝুমা রানী সাহার সঙ্গে বসবাস করতেন। তাঁরা সুজনকে ২০১১ সাল থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন। চিকিৎসায় ভালো না হওয়ায় তাঁকে সম্ভব মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়।

পিবিআইয়ের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ওই মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের রোগীরা সুযোগ পেলেই ছাদে উঠে পালানোর চেষ্টা করতেন। তখন নিরাময় কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আরিফ হোসেন (৪৫) ও কর্মচারী আসিফ হোসেন (৪৫) তাঁদের মারপিট করে নিচে নামাতেন। আশপাশের বাসিন্দারা প্রায়ই সেখান থেকে আর্তচিৎকার শুনতে পেতেন।

সুজনকে ভর্তির পর চিকিৎসার পাশাপাশি তাঁকেও শারীরিক নির্যাতন করতেন আরিফ ও আসিফ। ২০১৯ সালের ২৯ নভেম্বর নির্যাতনে সুজন অসুস্থ হয়ে পড়লে বিষয়টি তাঁর স্বজনদের জানানো হয়নি। নিরাময় কেন্দ্রের আরিফ ও আসিফ তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে নেওয়ার আগেই সুজনের মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আঘাতজনিত কারণেই সুজনের মৃত্যু হয়েছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সম্ভব মাদকাসক্ত চিকিৎসা সহায়তা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আরিফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটি এখন বিচারাধীন। সুজনকে কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়নি। তিনি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা গেছেন। বিষয়টি থানা-পুলিশ ও পিবিআইকে বলা হয়েছে। সুজনের ভাই-বোনদের বিরোধের মধ্যে পড়ে তিনি ফেঁসে গেছেন। বিষয়টি আদালতকে জানাবেন।

পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

পিবিআই জানিয়েছে, মামলার এজাহারভুক্ত আসামি খোকন সাহা ও বাদী গঙ্গা রানী সাহা ভাই-বোন। তাঁদের বাবা-মা বেঁচে নেই। তাঁরা যে বাড়িতে বসবাস করেন সেটি তাঁদের পৈত্রিক সম্পত্তি। এই বাড়ির ভাড়া তোলা নিয়ে খোকন সাহা ও তাঁর স্ত্রী ঝুমা রানী সাহার সঙ্গে গঙ্গা রানী সাহার দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। এই বিরোধের কারণেই সুজনের মৃত্যুর পর খোকন ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেন গঙ্গা রানী সাহা।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা জেলা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে এজাহারভুক্ত দুই আসামি খোকন ও তাঁর স্ত্রীর কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে তাঁদের আসামি করা হয়। তবে নিরাময় কেন্দ্রের দুজনের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

এদিকে মামলার বাদী গঙ্গা রানী সাহার ভাষ্য, খোকন সাহা ও তাঁর স্ত্রী ঝুমা রানী সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরেই সুজনকে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তির নাম করে হত্যা করেছেন। তদন্তে সঠিক বিষয়টি উঠে আসেনি। থানা-পুলিশের তদন্তের পর তিনি নারাজি দিয়েছিলেন। এবার আর্থিক সংকটের কারণে নারাজি দিতে পারেননি। মামলা লড়ার মতো আর্থিক সচ্ছলতা এলে তিনি নারাজি দেবেন।

সাড়ে তিন বছরেও নেওয়া হয়নি ব্যবস্থা

থানা-পুলিশের তদন্তর পর পিবিআইয়ের তদন্তেও রোগীদের নির্যাতনের তথ্য উঠে এসেছে কেরানীগঞ্জের সম্ভব মাদকাসক্ত চিকিৎসা সহায়তা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। নিরাময় কেন্দ্রে রোগীদের চিকিৎসাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো ঠিকমতো চলছে কি না, সেটি দেখভালের দায়িত্ব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। তবে ঘটনার সাড়ে তিন বছরেও নিরাময় কেন্দ্রটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংস্থাটি।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা জেলার উপপরিচালক মো. বাহাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সম্ভব মাদকাসক্ত চিকিৎসা সহায়তা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে এমন তথ্য তাঁর জানা নেই। তিনি এ বিষয়ে খোঁজ নেবেন। আর আদালত কোনো নির্দেশনা দিলে তা প্রতিপালন করবেন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category