-রিন্টু আনোয়ার
নির্বাচনের তেতো মাঠে বাড়তি গরম দিয়ে বিতরণের পর ফেরত নেয়া হয়েছে তৃতীয় শ্রেণির ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার বই। ঘটনা প্রথম ধরা পড়ে সাতক্ষীরায়। ঠাকুরগাঁওসহ আরো কয়েক জায়গায়ও তা বিতরণ হয়। বইটির প্রচ্ছদে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এমন বিষয়বস্তু পাওয়ায় বুধবার সকাল এগারোটার মধ্যে তা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে উপজেলা শিক্ষা অফিসে ফেরত পাঠানো হয়। নতুন বছরের প্রথম দিন বেশ গর্বের সঙ্গে উৎসবমুখর পরিবেশে সারাদেশে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হয়। সেদিন বিতরণ করা তৃতীয় শ্রেণির ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ের কিছু বইয়ের মলাটের নিচের অংশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেবী দুর্গার ছবি রয়েছে। এটি হিন্দু ধর্ম শিক্ষার ইংরেজি ভার্সনের বইয়ের মলাট। দ্রুত বইটির ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে শুরু হয়ে তুমুল সমালোচনা। বিষয়টি নজরে আসার পর পরই তৃতীয় শ্রেণির ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইটি তুলে নেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড – এনসিটিবি। এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, এটা ছাপাখানার ভুল। বইটির উল্টো পাশে হিন্দু ধর্ম শিক্ষা বইয়ের ইংরেজি ভার্সনের মলাট থেকে যাওয়া ছাপাখানার ভুল।
প্রশ্ন হচ্ছে, ভুলের আর জায়গা পেলো না? তাও কী নিয়ে ভুল? এখন তো ওয়েব মেশিনে বই ছাপা হয়। সেখানে ভুল হয়ে থাকলে কয়েক হাজার বইয়ে এ ভুল হওয়ার কথা। কিন্তু অল্প কিছু বইয়ে কেন এ ভুল? তাই এটি ছাপাখানার ভুল না তলে তলে ইসলাম ও মুসলিমদের চেতনাবোধে পরিকল্পিত আঘাত বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল – এ প্রশ্ন থেকেই যায়। আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে একটা নিম্মানের বিতর্ক চলছে গত বছর কয়েক থেকেই। একটার পর একটা গোলমাল পাকছে। তারওপর পাঠ্য বইয়ে ছাপার ভুল, গুগল থেকে নামিয়ে কপি পেস্ট, ছাগলকে গাঠে উঠিয়ে দেয়া,এবার এসে দেবীর প্রবেশসহ যাচ্ছে তাই যতো কাণ্ডকীর্তি। মৌলিকতা বাদ দিয়ে শিক্ষা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট হয়ে যাচ্ছে বেশি পর্যায়ে। সৃজনশীল, এমসিকিউসহ কতো কী? এমনিতেই দেশে অন্তত এগারো কিছিমের শিক্ষা ব্যবস্থা ধাবমান-চলমান। আবার মাঝেমধ্যে একমুখীতার কথা বলে বহুমুখীতার প্রবণতা। আজ বৃত্তি, কাল বৃত্তি তুলে দেয়া। যখন যেটা মন চায়, সেটার পক্ষে ব্যাপক যুক্তি। আর কিছু লোকের এতে সায় দিয়ে নেমে পড়া। বাংলাদেশের মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলোর বেশিরভাগই বেসরকারি বা এমপিওভুক্ত বেসরকারি।ছাত্রবেতন দিয়ে চলতে হয় শিক্ষা এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কখনো সরকারি, কখনো স্থানিয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কতো খবরদারি সইতে হয়, তা মর্মে মর্মে জানেন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা। কিছুদিন তা চলেছে শিক্ষাবৃত্তি নিয়েও।
নতুন কারিকুলাম চালু হওয়ায় প্রাথমিক ও জুনিয়ার বৃত্তি উঠে গেছে। কারিকুলাম ও মূল্যায়ন ব্যবস্থার সাথে বৈপরীত্যের কারণ দেখিয়ে এটা বাতিল করা হয়েছে। আশির দশকের শুরুতে প্রাথমিক স্তরের শেষ ক্লাস ৫ম শ্রেণিতে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তির পরিমাণ ছিল মাসিক ৩০ টাকা এবং টেলেণ্টপুলে ১২৫ টাকা। অর্থাৎ সাধারণ গ্রেডের চেয়ে টেলেণ্টপুলে বৃত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ গুণেরও বেশি। তখন জুনিয়র স্তরে মানে ৮ম শ্রেণিতে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তির পরিমাণ ছিল মাসিক ৫০ টাকা। টেলেণ্টপুলে ৩০০ টাকা, অর্থাৎ সাধারণ গ্রেডের চেয়ে ৬ গুণ বেশী। তখন মাধ্যমিক স্তরে স্কুলের বেতন ছিল শ্রেণিভেদে ৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ বেতনের তুলনায় বৃত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫-১০ গুণ বেশি। বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ও ভর্তিবাবদ ব্যয় মওকুফ করা হতো বলে বৃত্তির টাকা দিয়ে তারা খাতা-কলম, বইপুস্তক, প্রাইভেট-কোচিং ইত্যাদি ব্যয় মেটাতে পারতো। নইলে কেউ কেউ সেখান থেকে কিছু সঞ্চয় করতো।
শিক্ষা অন্য কটি খাতের মতো নয়, তা মনে না রাখলেও যেন কারো সমস্যা হচ্ছে না। যে কোনো কারিকুলাম প্রণয়ন, টেক্সট উপস্থাপন, অনুশীলন নির্ধারণ, মূল্যায়ন ও অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুলো সবার আগে বিবেচনা করা হয়। পাঠ পরিকল্পনা ছিল প্রথমত প্রান্তের ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানে পিছিয়ে দেওয়া এবং দ্বিতীয়ত হলো তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতি, কাঠামোগত সংস্কার, ইত্যাদির নামে ব্যাংক ও বাণিজ্যখাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে লোকবল সরবরাহ বাড়াতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমিয়ে বাণিজ্যতে সরিয়ে নেওয়া, সে-কারণে এইসব প্রশ্ন একেবারেই বিবেচনা করার সুযোগ পরিকল্পনাকারীদের ছিল না, সরকার বা বিশেষজ্ঞদেরও ছিল না। আর যেহেতু বিজ্ঞান শাখা বন্ধ করে দিলে বা খোলার অনুমতি না দিলে সামাজিক প্রতিক্রিয়া হবে, শাখা খোলা ও ল্যাব প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির ব্যবসাও কম হবে, ফলে সেই নেতিবাচক পথ পরিহার করা ছিল খুবই যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত। ফলে আশির দশকের শুরুতে এসএসসিতে বিজ্ঞান শাখার যতো শিক্ষার্থী ছিল, সব দিক বিবেচনা করে সেই সুন্দর বইটা দিয়ে নব্বই দশকের শুরুতেই তার প্রায় অর্ধেক কমানো সম্ভব হয় এবং পরিকল্পনা দারুণভাবে সফল হয়। এরপর আবার সেই বই ইভ্যালুয়েশন করে বাতিল করে ভিন্ন বিজ্ঞান বই প্রণয়ন করা হলেও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা আর ফিরে আসেনি। ক্লাস নাইট-টেনে গণিত-বিজ্ঞান একটুও কমছে না বরং বাড়ছে—তবে গণিত-বিজ্ঞানের ভয়ে বা অপছন্দ থেকে যে ৩ ভাগের ২ ভাগ শিক্ষার্থী বাণিজ্য বা কলা শাখায় যেতো, তারা এখন কিভাবে উত্তীর্ণ হবে? নাকি ত্রিভুজ বা চতুর্ভুজ একটা মার্কা দিয়ে দিলেই হবে প্রশ্নফাঁস আর শতভাগ পাশের মতো করে? এ ধরনের অনেক প্রশ্ন থাকলেও জবাব নেই। জবাব দিতেও হয় না। এখনও হচ্ছে না। ভবিষ্যতে হয় কিনা , কে জানে!
শিক্ষার যে আক্ষরিক অথবা অন্তর্নিহিত অর্থ তা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অপ্রতুল। যে কোনো শিশুর বেড়ে ওঠার পথপরিক্রমায় সামাজিকীকরণে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেগুলোর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত। সেখানে এখনো কর্মমুখী শিক্ষা অনুপস্থিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জীবনের চলার পথে কী কী প্রয়োজনে এবং সেগুলো কিভাবে করতে হবে তা শেখানোর ব্যবস্থা নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেবল পড়তে, লিখতে বা হিসাব করতে শেখা পর্যন্ত সীমিত রাখায় কর্মমুখী শিক্ষার দিকটি উহ্যই থেকে যাচ্ছে। দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য রান্না-বান্না, ট্রাফিক রুলস, প্রাথমিক চিকিৎসা, আত্মরক্ষা, ঘরদোর গোছানো, জামা-কাপড় কাচা, নৈতিক শিক্ষা, খেলাধূলা, সঙ্গীত, নৃত্য, সাঁতারসহ নিত্য জরুরি পর্বগুলো এখানে অনুপস্থিত। শিক্ষার এই এই ফাঁকা ব্যবস্থা জাতির মেরুদণ্ডকে মোটেই পোক্ত করছে না। বিত্তবান তথা নীতি-নির্ধারকরা তাদের সন্তানদের এই শিক্ষায় সামিল করছেন না। বুঝে-শুনেই এই কৌশল তাদের। কুদরাত এ খুদা শিক্ষা কমিশন (১৯৭৪) এবং জাতীয় শিক্ষানীতি (২০১০) এ বর্ণিত বৈষম্যহীন একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থার কথা তারাও বলেন। কিন্তু, বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখেন না। এ ট্র্যাজেডিতেই টিকে আছে বা এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। বহুকাল ধরে শিক্ষার্থীরা স্কুলে গিয়ে ক্লাস করতো আর শিক্ষকরা ক্লাস নিতেন, কিন্তু নতুন কারিকুলামে তা আর হবে না; কারণ এখন থেকে শিক্ষকরা সেশন নিবেন এবং শিক্ষার্থীরা সেশনে অংশগ্রহণ করবে। এবার বুঝি বিশাল কিছু ঘটে যাবেই। অনেক বছর আগে একবার প্রাথমিক স্তরে শ্রেণীগুলোকে গ্রেড নাম দিয়ে শিক্ষা-উন্নয়ন ঘটাতে দেখা গিয়েছিল। নিশ্চয় তাতেও অনেক উন্নয়ন ঘটেছিল। সামনে আরো ঘটবে।
২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতির ভিত্তিতে ২০১২ সালে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করে সৃজনশীল করা হয়। তার ব্যর্থতা নিয়ে নানা তথ্য রয়েছে। ২০২১ সালে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়, যার সাথে জাতীয় শিক্ষানীতির সে-অর্থে কোনো সম্পর্ক নেই। কেন নেই? কাউকে জবাব দিতে হয় না। কেউ জবাব দিতে বাধ্য নন। শিক্ষানীতিতে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত করা এবং সকল শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা ছিল। তা হয়নি। কেন হয়নি সেটার ব্যাখ্যা নেই। শিক্ষানীতিতে ১ম থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নতুন কারিকুলাম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক সহায়িকা প্রণয়নের কথা ছিল। তাও হয়নি। কেন হয়নি, সেটারও ব্যাখ্যা নেই। ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম শ্রেণীতে বৃত্তিমূলক ও তথ্যপ্রযুক্তি শেখানোর কথা বলা হয়েছিল। এখন একেবারে একলাফে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা। ১ম ও ২য় শ্রেণীতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং এরপর প্রশ্নভিত্তিক লিখিত পরীক্ষা পদ্ধতি চালুর কথাও বলা হলেও এখন প্রথম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও প্রশ্নহীন পরীক্ষা পদ্ধতির ঘনঘটা। রীতিমতো আচানক কাণ্ড। না আছে জবাবদিহিতা, না গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com