কৃষিতে শ্রমিক স্বল্পতায় শ্রমঘন কাজগুলোতে যন্ত্রের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। ধান চাষাবাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে বীজ ছিটানো ও চারা রোপণ অন্যতম। প্রচলিত পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপণে অধিক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবন করেছে সিড সোয়ার মেশিন। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে গবেষণাকাজ। এ মেশিন একই সঙ্গে ধানের বীজ ছিটানো ও চারা রোপণ করতে সক্ষম। সিড সোয়ার মেশিনটি ঘণ্টায় ৭ হাজার বীজ ছিটাতে সক্ষম।
প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে মেশিনটির গবেষণাকাজ সম্পন্ন করা হয়। গবেষণা অনুযায়ী— মেশিনটি বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে হস্তান্তরের উপযোগী। এটি দিয়ে স্বল্পশ্রমে সমভাবে ঘণ্টায় সাত হাজার থেকে সাত হাজার তিনশ বীজ ছিটানো যাবে। মেশিনটির অ্যাডাপটিভ ট্রায়ালের জন্য ৫০টি যন্ত্র প্রস্তুত করে পাঁচটি প্রায়োগিক গবেষণার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে হস্তান্তর করা হয়েছে।
‘যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদের লক্ষ্যে খামার যন্ত্রপাতি গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধিকরণ (এসএফএমআরএ)’ প্রকল্পের আওতায় ব্রি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগ দেশের সাত বিভাগের ১২ জেলার ১২ উপজেলাকে প্রকল্প এলাকা হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। জেলাগুলো হলো- গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, বরিশাল, হবিগঞ্জ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, ফেনী, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা ও কুষ্টিয়া। চলতি অর্থবছর প্রকল্পের বেশকিছু গবেষণাকাজ সম্পন্ন হয়েছে।
ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর জাগো নিউজকে বলেন, স্বল্পপর্যায়ে ব্রি সিড সোয়ার মেশিন কৃষকের কাছে পৌঁছাবে। সরকারের সিদ্ধান্ত মেশিনটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার। এজন্য কাজ শুরু হয়েছে। কয়েকটি কোম্পানি পেয়েছি তারা এটা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে প্রস্তুত। আশা করছি, আগামী মৌসুমে এটা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারবো। আমরা ট্রান্সপ্ল্যান্টারও তৈরি করেছি। এর সাহায্যে জমিতে ধানের চারা রোপণ সহজ হয়। কৃষক ধান লাগানোর সময় যখন চারা নিতে যান তখন ওই জায়গাটা ফাঁকা থাকে। কিন্তু ট্রান্সপ্ল্যান্টারে এ গ্যাপ (ফাঁকা) থাকবে না। ট্রান্সপ্ল্যান্টার ও ব্রি সিড সোয়ার মেশিন একসঙ্গে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেবো। এগুলো যারা বিক্রি করছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি।’
ব্রি সিড সোয়ার মেশিনের উপকারিতা
যন্ত্রটি ব্যবহারে সময়, খরচ ও শ্রম সাশ্রয় হয়। নিয়ন্ত্রিত ও সমানভাবে বীজ ছিটানো যায়। সব চারা সমানভাবে বাড়ে। চারাগুলো সমভাবে বিস্তৃত থাকায় মিসিং হিলের পরিমাণ কম হয়। ব্রি বীজ বপন যন্ত্রটি ধানের চারা রোপণ যন্ত্র জনপ্রিয়করণে সহযোগী/অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, বোরো মৌসুমে ‘ব্রি হোল ফিড কম্বাইন হারভেস্টার’র মাঠ পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। যন্ত্রটি ১৬ থেকে ২০ সেন্টি মিটার পানিযুক্ত ও কর্দমাক্ত জমিতে সহজেই কাজ করে। যন্ত্রটি ১১৫ থেকে ১২৫ সেন্টিমিটার উচ্চতার এবং হেলে পড়া ফসল সহজেই কাটতে পারে। ঘণ্টায় এক একর জমির ধান কাটা যায়। যন্ত্রটির জ্বালানি খরচ ঘণ্টায় একরপ্রতি ১০ লিটার এবং হারভেস্টিং লস শতকরা এক শতাংশেরও কম। আমন মৌসুমেও ব্রি হোল ফিড কম্বাইন হারভেস্টারের মাঠ পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। ঘণ্টায় সহজেই এক একর জমির ধান কাটা যায়।
এছাড়া সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার এবং ২৫ সেন্টিমিটারের দুটি পাওয়ার রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার উন্নয়ন করা হয়েছে। চারার সংখ্যা নির্ধারণের ওপর কাজ করা হয়েছে। পিকারের পজিশন পরিবর্তন করা হয়েছে। মাঠে কার্যকারিতা পরীক্ষা করাসহ ত্রুটিগুলো শনাক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে ত্রুটিমুক্ত করার কাজ চলমান। পাওয়ার উইডারের ১৬টি মডেল প্রস্তুত করা হয়েছে। ল্যাবরেটরি ট্রায়াল চলছে। মাঠে পরীক্ষা করে ত্রুটি শনাক্ত করা হয়েছে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার এবং ২৫ সেন্টিমিটার উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। নরম মাটিতে চলাচলের উপযোগীর জন্য স্কিড সংযোজন করা হয়েছে। মাঠে পরীক্ষা চলছে এবং অ্যাডাপটিভ ট্রায়ালের জন্য কৃষকের জমি নির্বাচন করা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় পোকা দমনে সৌরচালিত আলোক ফাঁদের কার্যকর ব্যবহারের জন্য ১২ ভোল্ট (ইনপুট) প্যানেলকে ৬ ভোল্টে (আউটপুট) রূপান্তর করা হয়েছে। দুটি ৬ ভোল্টের ব্যাটারি সমান্তরালে সংযোগ করা হয়েছে, যার ফলে মোট আউটপুট হয়েছে ৬ ভোল্ট। কিন্তু অ্যাম্পিয়ার দেওয়া হয়েছে আগের শ্রেণির সংযোগের তুলনায় দ্বিগুণ। ফলে কোনো একটি ব্যাটারি ঠিকমতো কাজ না করলেও বাল্বটি ঠিক মতোই জ্বলবে। বর্তমানে ৬ ভোল্ট ৩ পাওয়ারের আল্ট্রা ভায়োলেট এলইডি বাল্ব ব্যবহার করা হয়েছে, যা আগে ছিল ১২ ভোল্ট ৩ পাওয়ার। ফলে শক্তির সাশ্রয় হয়েছে এবং অধিক সময় ধরে বাল্বটি জ্বলবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্পটি ‘বি’ ক্যাটাগরি অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ বরাদ্দের ২৫ শতাংশ কম অর্থ ছাড় হবে। চলতি অর্থবছরের এডিপিতে প্রকল্পে ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে, যার মধ্যে আবর্তক খাতে ৬ কোটি এবং মূলধন খাতে ৭ কোটি টাকা।
মূলধনখাতে প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমগুলো হলো- প্রশিক্ষণ ও প্রায়োগিক প্রদর্শনীর জন্য খামার যন্ত্রপাতি, গবেষণার ওয়ার্কশপ যন্ত্রপাতি, ল্যাব যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি, অফিস যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি, আসবাবপত্র সংগ্রহ এবং আবর্তক খাতে বেতন-ভাতা, শ্রমিকের নগদ মজুরি, পণ্য ও সেবার ব্যবহার, প্রশাসনিক ব্যয়। চলতি অর্থবছর প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তিতে ৪৮ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে এবং ব্যয় হয়েছে ৪৫ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের মাত্র ৪৬ শতাংশ।
প্রকল্পটি ৪৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন করেন পরিকল্পনামন্ত্রী। প্রকল্পটি দেশের সাত বিভাগের ১২টি জেলার ১২টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে।
প্রকল্পের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো টেকসই ধান চাষাবাদের লক্ষ্যে লাগসই কৃষি যন্ত্রপাতি উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য খামার যন্ত্রপাতি গবেষণা কার্যক্রম জোরদারকরণ।
প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যগুলো হলো— কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ লাগসই নয়টি কৃষি যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন/উন্নয়ন করা, ব্রি উদ্ভাবিত কৃষিযন্ত্রের ৩২৪টি প্রায়োগিক মাঠ পরীক্ষণের মাধ্যমে যন্ত্রের ত্রুটি-বিস্তৃতি সম্পর্কে মতামত সংগ্রহ করে যন্ত্রের অধিকতর উন্নয়ন করা, ব্রি উদ্ভাবিত ও আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সম্পর্কে দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ৬ হাজার ৪৮০ জন যন্ত্রচালক, অগ্রসর কৃষক, মেকানিক ও সেবা প্রদানকারী উদ্যোক্তা এবং ২০০ জন স্থানীয় কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক ও সম্প্রসারণ কর্মকর্তা/কর্মীকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি গবেষণার জন্য ২০ জন বিজ্ঞানী এবং ২০ জন ওয়ার্কশপ কর্মীকে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলা এবং বিদ্যমান কৃষি যন্ত্রপাতি গবেষণা ল্যাব-কাম-ওয়ার্কশপের আধুনিকায়ন।
প্রকল্পের আওতায় উদ্ভাবিত যন্ত্রগুলোর ভিডিও ডকুমেন্টারির কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং যন্ত্রগুলোর বিজনেস মডেল তৈরির জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়েছে। এর আগে হোল ফিড কম্বাইন্ড হারভেস্টারের বিজনেস মডেল তৈরি করা হয়েছে এবং ব্রি বীজ বপন যন্ত্রের বিজনেস মডেল প্রস্তুতের কাজ চলছে। ব্রি বীজ বপন যন্ত্রের অ্যাডাপটিভ ট্রায়ালের মাধ্যমে গ্রামের নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। যাতে তারা সহজেই স্বল্পসময়ে বীজ বপন যন্ত্র ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করতে পারেন।