-রিন্টু আনোয়ার
টানা বঞ্চনার দহন আছে সংৃখ্যালঘুদের মাঝে। আর সংখ্যালঘু মানে সনাতন ধর্মাবলম্বী। আরো খোলাসা করে বললে হিন্দু সম্প্রদায়। বৌদ্ধ-খ্রিস্টানও এর অন্তভূক্ত। কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বলতে প্রতীকি হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায়ের নামই আগে উঠে আসে।কারণ তাদের চেয়ে বৌদ্ধ-খ্রিস্টানরা সংখ্যায় আরো কম বলে। কিন্তু, ধর্ম দিয়ে লঘু-গুরুর সংখ্যামাপিক পরিচয় অসম্মানের। তা অনেকটাই তাচ্ছিল্যের মতো। যা
মর্যাদাবোধে আঘাত। পবিত্র ইসলাম ধর্মে এটি কঠোরভাবে বারণ করা আছে। এরপরও বহুল ব্যবহারের কারণে লেখায়-বলায় গেঁথে গেছে শব্দটি। ইসলামে সংখ্যালঘু বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সমাজের–রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা বলা আছে সুনির্দিষ্টভাবে। মুসলিমদের দায়িত্ব আরো বেশি অন্য ধর্মালম্বীদের প্রতি। কিন্তু, রাজনৈতিক কারণে সংখ্যালঘুদের করে ফেলা হয়েছে একেবারে উপাদান বা আইটেম। পূজা-পার্বনসহ বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অমুসলিম নাগরিকদের ওপর হামলা-নির্যাতনের পেছনে রাজনীতির কারসাজিই বেশি। তাদের ওপর আঘাত করে প্রতিবাদের আয়োজন করে কাছে টানার একটি সুক্ষ নোংরামি অনেকটা ওপেন সিক্রেট। কারো এই কাণ্ডগুলো করে হিন্দু সম্প্রদায় তা ভালো করেই জানে। কিন্তু, মুখ খুলে বলতে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের দরদী নেতারাই যে এসব কাণ্ডের হোতা-কর্তা তা জেনে-বুঝেও হজম করে বা করতে হয়। গণ্ডগোল যে ধর্মীয় কারণে নয়, তাও তারা জানে। এরপরও শেখানো বুলি বলতে হয়। তবে সম্প্রতি পুজার আগ থেকে একটু একটু করে কিছু কঠিন কথা বলা শুরু করেছে।
পূজা উদযাপন পরিষদ নেতাদের মুখও আটকানো যায়নি। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়ের সময় ছোট ছোট কিছু কথা বলেছেন তারা। তাদের ছোট কথাগুলোর মাঝে বড় বড় কিছু টোকা ও টিকা রয়েছে। পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যাতে কোনো হামলা না হয়; সে জন্য সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানিয়েছেন। এসময় পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক বলেন, কিছু মানুষ চায় না দেশে হিন্দুরা থাকুক। আওয়ামী লীগেও এমন ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সাম্প্রদায়িক হামলার পূনরাত্তি যাতে না ঘটে সেই আহ্বান জানিয়ে স্বাধীনভাবে পূজা উদযাপনে সবার সহায়তাও চেয়ে ছিলেন জে এল ভৌমিক। একই দিন প্রায় একই সময়ে কুমিল্লায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বিক্ষোভে পুলিশের বাধা। যুবলীগ-ছাত্রলীগের ধাওয়া। কুমিল্লা কান্দিরপাড় পুবালী চত্বর থেকে তারা বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মিছিলকারীদের ধাওয়া করে। এতে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। ‘মদমুক্ত পূজা’ নিয়ে সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের বক্তব্যকে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য উল্লেখ করে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদ।
দেশে রাজনীতির পণ্য বানাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে কব্জা করে রাখার চর্চা বহুদিনের। আবার তারা তাদের পছন্দের দলের হাতে নিগৃহিত হয়ে কাঁতরালে তৃপ্তি পাওয়ার মহলও আছে। ক’দিন আগে রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নেতা অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত। সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, কী দেবেন-কী নেবেন এবার আগেই ফয়সালা করতে হবে। আরেক বক্তব্যে বলেছেন, সরকার চাইলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, না চাইলে হয় না।
আবার সংখ্যালঘুরা মার খেলে আরো খাক, খেতে থাকুক, তারা তো ওদিকেরই লোক- এমনটি ভেবে বিকৃত স্বস্তি বোধকারীদের মতিগতিও স্পষ্ট। আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় ফুঁসছে সংখ্যালঘুদের সংগঠনগুলো। নির্বাচন সামনে রেখে তারা সেই ক্ষোভ ঝাড়ছে সরকারের ওপর। সরকারও কাছে টানছে। পিঠ বুলাচ্ছে। কোনো ধর্মাবলম্বীদের মাথা গুনে লঘু-গুরু ঠিক করার এই টোকাটুকি আমাদের অনেক সর্বনাশ করেছে। তাও একবার দুবার নয়, বারবার। এবার ধর্মীয় ’সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু’ রেখা টানার পুরানো খেলাটা বেশি আগে শুরু হয়ে গেছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ব্যানারে সংখ্যালঘুদের এ ধরনের প্রশ্নের তীর ছোঁড়া আচানক বা আজগুবি নয়। একদম আকস্মিকও নয়। এর নেপথ্যে নানা ঘটনা লুকানো। বছর কয়েক ধরে হেফাজতসহ দক্ষিণপন্থী বা ইসলামি নামধারী সংগঠনগুলোর বেশিরভাগও তাদের কব্জায়। এ বিষয়ক চাপা আলোচনা ও গুঞ্জনের মাঝেই নির্বাচনে সংখ্যালঘুরা ১০০ আসনের ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে বলে বার্তা দিয়েছে। আরেক অনুষ্ঠানে সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল এবং সহযোগী বামপন্থিরা একসঙ্গে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও দেশ কেন এত সাম্প্রদায়িক? সরকারের কাছ থেকে এ প্রশ্নের জবাব আদায় করে ছাড়ার কড়া হুঙ্কারের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের আর রাজনীতির দাবা গুটি না বানানোর আহ্বানও জানানো হয়। এমন একটি সময়েই সোজাসাপ্টা একটি কঠিন অভিযোগ ছুঁড়ে মেরেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। বলেই ফেলেছেন- সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষমতাসীনরাই জড়িত থাকে। তাই নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা সঠিক বিচার পায় না। সংখ্যালঘুদের জমি ও সম্পদ দখলের সঙ্গেও ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই জড়িত থাকে। এজন্য দেবোত্তর সম্পত্তি আইন পাশ করছে না সরকার। মুখ ফসকে হোক আর রাজনীতির সমীকরণ মেলাতে হোক অপ্রিয় কথাটি তো বুলেটের মতো ফায়ার করে ফেলেছেন তিনি। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা তার সঙ্গে তাদের কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাত করতে গেলে তিনি এ কথা বলেন।
এ সময় বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানাদাশ গুপ্ত বক্তব্য রাখতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি কথা টেনে এনে বললেন, তিনি(ওবায়দুল কাদের)কেন বলেছিলেন সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হতে পারে। এর কয়েক দিন পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই বা কেন বলেছেন—আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করে বিএনপির ওপর দোষারোপ করতে পারে। রানা দাশ গুপ্তের প্রশ্ন কাদের-ফখরুলরা কেন এভাবে হিন্দুদের ভয় দেখান..। এতে সংখ্যালঘুরা আতক্ঙিত হয়। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পার্বত্য ভূমি কমিশন গঠন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের বাস্তবায়ন এবং দেবোত্তর সম্পত্তি আইন প্রণয়নের দাবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকের অংশ হিসেবে জায়গায়-জায়গায় এ সব কথা বলেছেন রানা দাশ গুপ্ত, ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক, মিলন কান্তি দত্ত ও রঞ্জন কর্মকাররা। মোটকথা বলার আর কিছু বাদ রাখেননি তারা।
হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের আলোকিত জনপদ হলো এই বাংলাদেশ। আবহমানকাল থেকে এই জনপদে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ পারস্পরিক সহমর্মিতা, হৃদ্যতা ও মমত্ববোধের সঙ্গে সহাবস্থান করে আসছে। জাতিগত, গোষ্ঠীগত বা ধর্মগত পার্থক্যের কারণে এ দেশে কোনো সম্প্রদায় কখনও নিগৃহীত হয়নি; সংখ্যালঘুর তকমা মাখিয়ে কাউকে নির্যাতনের শিকারও করা হয়নি। কিন্তু এ সহাবস্থানকেও সুযোগ হিসেবে নিয়েছে রাজনৈতিক মহল বিশেষ। গণ্ডগোল পাকিয়ে সেখান থেকে মওকা নেয়ার নোংরাকাণ্ড ঘটানোর কাজে তারা বেশ সফলকাম হয়ে চলছে। সেখানে এখন পর্যন্ত কোনো শক্ত বাধা না পড়লেও কথাগুলো কিন্তু উচচারিত হচ্ছে বেশি মাত্রায়। হচ্ছে কিছু বিশ্লেষণও। আগে যা এভাবে হয়নি। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ভোটার শতকরা ১০ ভাগ। নির্বাচনের মাঠে এই ১০ ভাগ ভোটার জয় পারাজয়ে বড় ফ্যাক্টর। তাদেরকে বলা হয় আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক। সেখানে গড়মিলও হচ্ছে। অন্ধভাবে অধীনস্থ হয়ে থেকে নিগৃহিত না হওয়ার বাসনা থেকে তারা এখন এদিক-সেদিক মোড় নেয়ার চেষ্টা করে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগেও একটা হিসাব আছে। তাদের কাছেও তথ্য আছে। জাতীয় ও স্থানীয় কয়েকটি নির্বাচন পর্যালোচনায় তারা দেখেছে, সংখ্যালঘু ভোটাররা এখন আর আওয়ামী লীগের একক ভোট ব্যাংক নয়। নানা হিসাব নিকাশ, মেরুকরণ এবং পর্যালোচনা করে তারা অন্যদিকেও চলে যায়। দল না দেখে অন্য দলের প্রার্থীর দিকেও চলে যায়। এমন কি জামায়াত বা আলেম গোছের প্রার্থীকেও ভোট দিয়ে বসে। যা আওয়ামী লীগের জন্য একটি লাল সংকেতের মতো। বাংলাদেশের বিভক্ত রাজনীতিতে সংখ্যালঘু ভোটাররা সামনে আরো বিভক্ত হয়ে কোন দিকে মোড় নেয় বা কোন দল তাদের কোন দিকে ছুটিয়ে নেয়- সেই ভয় এখন কাজ করছে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com