• শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০৩:৩৪ অপরাহ্ন

৬ বছরেই দেশের ৬৪ জেলা ঘুরেছেন সাফাত-শিখা দম্পতি!

Reporter Name / ৩৮ Time View
Update : রবিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

বাংলাদেশি হয়েও দেশের ৬৪ জেলা ঘুরে দেখেছেন এমন মানুষের সংখ্যা হয়তো খুব বেশি নয়। তবে এক দম্পতি আছেন, যারা বিগত ৬ বছরে দেশের ৬৪ জেলা ঘুরে বেড়িয়েছেন। বলছি, সাখাওয়াত হোসেন সাফাত ও জান্নাতুল ইসলাম শিখার কথা।

এই দম্পতি একে একে ঘুরে দেখেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সম্প্রতি তারা ফেসবুকে ‘৬৪ জেলা, ৬৪টি ছবি’ নামক একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন। যেখানে প্রতিটি ছবির ক্যাপশনে তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন।

‘৬৪ জেলা, ৬৪টি ছবি যেখানে গল্প থাকবে, আমাদের স্মৃতি থাকবে- এই চাওয়া নিয়েই আমাদের বাংলাদেশ ঘুরে দেখার যাত্রা শুরু হয়েছিলো’ বলে ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানান সাখাওয়াত হোসেন সাফাত। তিনি আরও জানান, ৬ বছর ধরে চলা এই জার্নিটা আমাদের কাছে প্রচণ্ড ভালোলাগার, ভীষণ মায়া আর আবেগের।

তাদের অ্যালবামের প্রথম ছবিতে দেখা যাচ্ছে রাতের ঢাকায় সোডিয়ামের আলোমাখা রাস্তায় হাত ধরে দু’জন হেঁটে চলেছেন… এই ছবির ক্যাপশনে লেখা, ‘আমি আর শিখা যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে প্রথম ঢাকা আসি, আমাদের কিছুই ভালো লাগতো না। একে তো পরিবারের থেকে দূরে, তার উপর যান্ত্রিক এই জীবন! এই সবকিছু দূরে ঠেলে আমরা একটু একটু করে নিজেদের ভালো লাগাগুলো বের করতে শুরু করলাম।’

‘ঘুরে বেড়ানো, ক্যাম্পাসের সকাল-সন্ধ্যা কাটানো সবকিছুতেই ক্রমে নিজেদের ব্যস্ত করলাম। আমাদের সেই স্মৃতিময় সময়ের অনেকটা কেটেছে ক্যাম্পাসের সোডিয়াম আলোয় হাত ধরে হেঁটে বেড়ানোতে। কীভাবে যেন মায়াবী এই জাদুর শহর ঢাকার প্রেমে পরে যাই আমরা।’

‘সেই সময়ে ক্যাম্পাসে দুজনের ছবি না থাকলেও ঢাকার রাস্তায় সোডিয়াম আলো দেখা একটা স্মৃতি আমাদের আছে ভাণ্ডারে। এক রাতের পাগলামিতে আমি আর শিখা বেরিয়ে পরি ঢাকার রাস্তায় ছবি তুলতে।’ সাফাত আরও লেখেন, ‘ঢাকা জেলায় তো আর আমাদের ছবির অভাব নেই, তবে অসম্ভব প্রিয় এই ছবিটাই হয়ে থাকুক আমাদের প্রাণের শহর ঢাকার স্মৃতি হয়ে।’

সাখাওয়াত হোসেন পেশায় একজন আলোকচিত্রী। তার স্ত্রী জান্নাতুল ইসলাম কর্মরত আছেন আইডিএলসি নামক বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। সাফাত-শিখা দম্পতি হিসেবেই এখন তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি পরিচিত।

তাদের ছবির অ্যালবামের আরও একটি সুন্দর ছবি যেটি তোলা হয়েছেন কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হাওরের অষ্টগ্রামের রাস্তায়। এই ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে ওই স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এ বিষয়ে সাফাত জানান, ৬৪ জেলা ঘুরে দেখার কল্যাণে কতভাবে কত কিছু যে ম্যানেজ করতে হয়েছে সেটা শুধু আমরাই জানি!

তিনি আরও বলেন, ‘কিশোরগঞ্জ যাওয়ার প্ল্যান চলছিলো অনেক আগে থেকেই, তবে বারবারই আটকে যাচ্ছিলো আমার আর শিখার সময়ের মারপ্যাঁচে! হঠাৎ একদিন প্রফেশনাল এক আউটডোর শুটের ডাক পড়ে কিশোরগঞ্জে। এই সুযোগ আর হাতছাড়া করা যায় না! তাই শিখা ছুটি নিলো অফিস থেকে।’

‘সারাদিনের রোদে গরমে কাজ করার পর ক্লান্তি নিয়েই বসে গেলাম অষ্টগ্রামের দারুণ রাস্তায়! শিখাও সারাদিন কাজ না থাকা সত্বেও শাড়িই পড়েছিলো শুধু এই ছবিটা তুলবে বলেই। এই ছিলো আমাদের জেলা উপাখ্যানের কিশোরগঞ্জ পর্ব।’

বান্দরবানের ডাবল ফলসের সামনে দাঁড়িয়ে তোলা ছবির ক্যাপশনে তারা লিখেছেন, ‘৬৪ জেলার সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত, আমার সবচেয়ে বেশি আবেগের ছবি এই বান্দরবানের ছবিটা। আমি আর শিখা যখন ৬৪ জেলার প্ল্যান করলাম, সিদ্ধান্ত নিলাম এখানেই আমাদের বান্দরবানের ছবি হবে। তবে বান্দরবান যাওয়া যদি সিদ্ধান্তের মতো সহজ হতো তাহলে তো কথাই ছিল না!’

‘বছর চারেক অপেক্ষা করেছি অনেকের জন্য। সময়, সুযোগ আর বান্দরবানের আবহাওয়া কোনোকিছুই যেন একসাথে ব্যাটেবলে মিলছিল না। অনেক হা-পিত্যেশের পর বন্ধু আরাফাত আর তার বউ মুনতাহাকে পেলাম। আর কোনদিক না তাকিয়েই আমরা চারজন রওনা দিলাম বান্দরবানের পথে।’

‘আলীকদম দিয়ে যাওয়া, আর্মি চেকপোস্ট পার হয়ে প্রথমে গেলাম নাফাখুম। আবহাওয়া আর পাহাড়ের গতিবিধি অনুকূলে না থাকায় আর অমিয়াখুম যাওয়া হয়নি। নাফাখুম আর লিলুক ঝরনা দেখে ফিরে এসে দুইটা সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। এক- ঢাকায় ফেরত যাওয়া আর দুই- আমাদের চার বছর ধরে লালন করা স্বপ্নটা পূরণ করা। দ্বিতীয়টাই বেছে নিলাম আমরা চারজন মিলে ‘

‘থানচি থেকে অর্ধেক সিএনজি আর অর্ধেক বাইকে চড়ে প্রথম যাই বাক্তলাই পাড়ায়। এই পাড়ায় আমাদের আগেও যাওয়া হয়েছিল। আগেরবার যেই রামলাল দাদার বাড়ি ছিলাম, তার ছেলেকে সাথে নিয়েই হাঁটা শুরু করলাম থাইক্যং পাড়ার পথে। পাহাড়িদের মতে আড়াই-তিন ঘণ্টার পথ, আমরা ধরেই নিলাম আমাদের স্ট্যামিনাতে সেটা ৪/৫ ঘণ্টার পথ হবে।’

সাফাত বলেন, ‘এতো সুন্দর ট্রেইল আমি বাংলাদেশের আর কোনো ট্রেকিং রুটে পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। তবে পুরো জার্নিতে শিখার সাপ দেখে চিৎকার, ডজনখানেক জোকের কামড়, মুনতাহার জীবনে প্রথম ট্রেকিং আর বৃষ্টি মাথায় করে পথচলা সবকিছু মিলিয়ে প্রতিমুহূর্তেই মনে হচ্ছিলো অ্যাডভেঞ্চারে ডুবে যাচ্ছি। চার ঘণ্টা হেঁটে, বৃষ্টি কাঁদায় মাখামাখি হয়ে আমরা পৌঁছাই থাইক্যংপাড়ায়।’

‘সুন্দর, ছবির মতো সাজানো একটা পাড়া। রাতটা এখানে থেকে ভোরবেলায় আমরা রওনা হবো ডাবল ফলসের উদ্দেশ্যে। বিকেল থেকে তুমুল বৃষ্টি হওয়ায় শুয়ে-বসেই আমরা সময় কাটালাম দিদির বাড়িতে। মনে মনে একটা টেনশনও ছিল বৃষ্টির এই তোরজোড়ে আমার স্বপ্নটা পূরণ হবে তো?’

‘ভোরবেলা যাত্রা শুরু হলো। বৃষ্টি তেমন নেই, কিন্তু পিচ্ছিল পথ। শুরুতেই শিখা একবার আছাড় খেলো। যাইহোক, এই পিচ্ছিল পথ ধরেই এগুতে থাকলাম আর ঘন্টাখানেক হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম আমার বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত সেই গন্তব্যে। আমি ঠিক সেই মুহূর্তে মনের অবস্থাটা কী ছিল বলে বোঝাতে পারবো না।’

‘ঝরনা রানিও যেন আমার স্বপ্নটা পূরণ করতেই উজাড় করা সৌন্দর্য মেলে দিয়েছিলো। আরাফাত-মুনতাহার কিছু ছবি তুলে নিলাম আমি, আর আমার আর শিখার এই ছবিটা তুলে দিলো আরাফাত। ছবির বিচারে এটি কেমন, ঝরনার বিশালত্ব ঠিক মতো বোঝা যাচ্ছে কি না সেই প্রশ্নোত্তরে আমি কখনোই যাবো না। তবে এই ছবি আমার চার বছরের অপেক্ষার ছবি, আমাদের স্বপ্নপূরণের ছবি!’

নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপে তোলা আরও এক ছবির অভিজ্ঞতায় সাফাত লেখেন, ‘নোয়াখালী আমার নিজের এলাকা, তবে সারাদেশ দেখার প্ল্যানিংয়ে যখন বসলাম তখন দেখলাম নিজের এলাকাটাই ঠিকমতো ঘুরে দেখা হয়নি। সিদ্ধান্ত নিলাম নিঝুম দ্বীপেই নোয়াখালীর ছবিটা তুলবো।’

‘তবে একলা একলা ওইদিকে যাওয়ার ঠিক সাহস হয়নি। আমাদের সঙ্গে জুড়ে গেলো পিয়া, নিলয়, বন্ধু আরাফাতসহ শিখার অফিসের আরও বেশ কিছু কলিগ। সবাই মিলে সদরঘাট থেকে লঞ্চে উঠলাম সন্ধ্যা ৬টায়! লঞ্চভর্তি মানুষ, কোনো রকমে ছোট একটি কেবিন পেয়েছি। সারারাত জার্নির পরে সকাল ৬টায় আমরা পৌঁছাই হাতিয়ায়।’

‘হাতিয়া থেকে আবার বাইকে চেপে নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সেই রাস্তা যেন শেষ হতেই চায় না! ঘণ্টা দেড়েক পরে এক নদীর পারে এসে থামলো বাইক। ভাবলাম এই বুঝি পৌঁছে গেছি! কিন্তু দেখলাম না! এই পর্যায়ে বরং অপেক্ষার শুরু নদীতে জোয়ার আসার। সব মিলিয়ে ১৮ ঘণ্টা পরে পৌঁছেছি কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য নিঝুম দ্বীপে।’

‘এরপর আবার ফেরার সময় আরেক লঙ্কাকাণ্ড করে হাতিয়া পার হয়ে লঞ্চে উঠলাম মনপুরা দ্বীপ থেকে। এই নিঝুম দ্বীপেই আমাদের প্রথম তাঁবুতে থাকা! নিঝুম দ্বীপের সৌন্দর্য দারুণ হলেও আমাদের মনে হয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর এলাকার মানুষরা ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি না হওয়ায় এলাকাটা একটু পিছিয়েই থাকবে।’

রাঙমাটির ধুপপানি ঝরনায় তোলা ছবিটির ইতিহাস নাকি বেশ পুরোনো! এ বিষয়ে সাফাত ক্যাপশনে লেখেন, ‘আমাদের এই ধুপপানি যাওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে। প্ল্যান মোতাবেক আমরা গিয়েছিলামও বিলাইছড়ি পর্যন্ত। তবে পারিবারিক এক সমস্যায় আমি গেলেও শিখার আর ধুপপানি যাওয়া হয়নি সেইবার।’

‘এরপর আমাদের বিয়ে হলো, অনেক জায়গা ঘোরাও হলো। তবে ধুপপানিতে আর যাওয়া হয়ে উঠছিলোনা। অনেকদিন অপেক্ষার পর, আমি, শিখা, নিলয়, রাকিব আর ফুয়াদ সবাই মিলে গেলাম ধুপপানি ঝরনা দেখতে। শিখার অনেকদিনের অপূর্ণ ইচ্ছেটা পুরণ হলো!’

‘যেহেতু ঝরনার ভেতরেই গুহা, আর আশপাশে অনেক মানুষ, ছবিটা ঠিকঠাক তুলতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে সবার তবু নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে সবাই চেষ্টা করেছে। যদিও এই ট্রিপ ছাড়াও আমাদের আরও অনেকবার রাঙামাটি যাওয়া হয়েছে।’

‘বিশেষ করে কাপ্তাই জায়গাটা আমাদের অনেক প্রিয়! তবে এই ছবির পেছনের যে একটা অপূর্ণতা আর অদেখা স্বপ্নের গল্প আছে, মূলত সেই কারণেই রাঙামাটির পৃষ্ঠাটা আমাদের ডায়রিতে এই ছবি দিয়ে পূরণ করে নিলাম।’

বরিশালের সাতলার শাপলা বিলে ড্রোন দিয়ে তোলা বিস্ময়কর এক ছবির ক্যাপশনে সাফাত লেখেন, ‘ছবিটি আমার বহু আকাঙ্ক্ষার, অনেকদিনের শখের ছবি। বরিশালের সাতলার শাপলা বিল দেখতে যাওয়ার শখ আমার অনেকদিনের। অনেক পরিকল্পনার পর অবশেষে ২০২১ এর আগস্টে আমরা শাপলা বিলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হই। বেশি সাতপাঁচ না ভেবেই উঠে পড়লাম বরিশালের লঞ্চে।’

‘সেবারও পেয়ারা বাজার, দুর্গাসাগর ঘুরে দেখলাম। সাঁতলা যাবার রাস্তাটা ভোলার না। ভোরবেলায় ঘণ্টাখানেকের রোলার কোস্টার রাইড শেষে আমরা পৌঁছালাম কাঙ্ক্ষিত সেই বিলে। পাখির চোখে শাপলা সহ সেই বিল, আমাদের দুজনের অজানা গন্তব্য আর ভেসে যাওয়া নৌকাসমেত স্মৃতিটা আমাদের খুব প্রিয়!’

সাফাত-শিখা দম্পতি সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে জানান, সৃষ্টিকর্তা যেভাবে আমাদের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে সাহায্য করেছেন, সেই শুকরিয়া হয়তো আজীবন ধরে করলেও কম পড়ে যাবে!


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category