ডিসেম্বরের ছুটিতে একদিন কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক মিলে কোনো শান্ত পরিবেশে আড্ডা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। একই সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা চলবে। কথামতো প্রোগ্রামও সাজালাম। প্রথমে যেতে চেয়েছিলাম কুষ্টিয়ার লালন শাহের মাজার ছেউড়িতে। পরে মতের পরিবর্তন হলো।
আমাদের দলে আমি ছাড়াও ছিলেন পাবনার কবি আদ্যনাথ ঘোষ, গোবিন্দলাল হালদার, টাঙ্গাইল থেকে এসেছেন এমরান হাসান, সম্প্রতি পাবনায় চাকুরিরত কবি বঙ্গরাখাল ও কবি জহিরুল ইসলাম। তারা সবাই এ সময়ে সাহিত্যে অবদান রেখে চলেছেন।
আড্ডার জন্য বেছে নিলাশ শতাব্দি প্রাচীন ও বিখ্যাত পাকশি যেখানে আছে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত একমাত্র লোহার রেল সেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও একই সঙ্গে দৃষ্টিনন্দন লালন শাহ সেতু। নিচে আছে শীতে কিছুটা সংকীর্ণ হয়ে আসা বর্ষার প্রমত্তা পদ্মা।
অদেখাকে দেখার ক্ষেত্রে আমার চিন্তা চেতনায় কেবল কবিগুরুর সেই কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে বাহির দুই পা ফেলিয়া, একটি ঘাসের ওপর একটি শিশির বিন্দু।’ বিশ্বাসও করি তাই। ঘরের সৌন্দর্য না দেখে বাইরের সৌন্দর্য দেখে কি লাভ?
তাই সুযোগ পেলেই ছুটে যাই দেশটাকে দেখতে। ঘর থেকে দুই পা ফেলে দেখার ইচ্ছে হয় বারবার। এর আগে গত বছর এসেছিলাম এখানে আমাদের প্রেসক্লাব থেকে। প্রতিদিন দূর দুরান্ত থেকে অগণিত পর্যটক একবার এই ঐতিহ্য দেখতে ছুটে আসে পরিবার পরিজন বা বন্ধুদের সঙ্গে।
এই পৌষের শীতেও অনেক পর্যটক এসেছেন। কিছুটা কুয়াশার বাড়াবাড়ি ছিল। এসব ভেদ করেই কেউ কেউ নৌকায় ঘুরছেন। যদিও মাঝিদের আয়-রোজগার এখন অনেক কম। বর্ষায় তাদের ব্যবসাটা জমে ওঠে। জেলেরা তাজা মাছ পাড়ে এনে হাঁকাহাকি করছেন। কয়েকজনকে দেখলাম কিনে নিতে।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সঙ্গে সঙ্গে লালন শাহ সেতুও দেখা হয়ে গেলো। কারণ এর পাশেই যে আধুনিককালের আমাদের দেশের আরেক স্থাপনা লালন শাহ সেতু অবস্থিত। আমি সেখানে আগেও গিয়েছি কয়েকবার। তবুও দেখা যেন শেষ হয় না! হওয়ার কথাও নয়। এত বিশাল লোহার সেতু আর কি চমৎকার শৈলী!
পাবনা থেকে মাত্র ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম সেখানে। যতবার সেখানে গিয়েছি ততবার মুগ্ধ হয়েছি। এত নিপুন ও দক্ষ কাজ দেখে! এখানে কিছু তথ্য দেওয়া দরকার। ১৯০৭ সালে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা ও ঈশ্বরদী উপজেলার মধ্যবর্তী পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে একটি ব্রীজ নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে কর্তৃপক্ষ।
১৯১৪ সালের শেষ দিকে ব্রিজটির কাজ শেষ হয়। ১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে ডাউন লাইন দিয়ে প্রথম মালগাড়ি চালানো হয়। সে সময় ব্রিজটি ট্রেন চলাচলের জন্য উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। তার নামানুসারেই ব্রীজটি নামকরণ করা হয়। তখনকার সময় ব্রীজটি তৈরিতে ব্যয় হয় ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ টাকা।
শত বছর পার করে আসা ব্রিজটি যতবার দেখি ততবার এক ধরনের আনন্দ বোধ করি। আমরা শীত মৌসুমে যাওয়ার জন্য পদ্মার জল ছিল অনেক দূরে। ব্রীজের নিচে অনেকদূর হেঁটে গেলে পদ্মার দেখা পাওয়া যায়। বহু চটপটি ও ফুচকার দোকান গড়ে উঠেছে সেখানে। আরও আছে চায়ের ব্যবস্থাও।
সেখানে সারি সারি নৌকা বাঁধা। নৌকায় আছে পদ্মার মাঝে চর থেকে ঘুরে আসার। অনেকেই সে সুযোগ নিচ্ছে। ব্রিজের নিচ দিয়ে বহু অস্থায়ী খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে। সার বেঁধে ঘুরতে আসা সবাই পদ্মার দিকে যাচ্ছে। কেউ দাড়িয়ে দেখছে আবার কেউ এদিক ওদিক ঘুরে ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করছে।
মাথার ওপর দিয়ে যখন ট্রেন চলে যায় তখন ওপরের মানুষগুলো নিচে দর্শনার্থীদের দিকে তাকিয়ে থাকে। দর্শনার্থীরাও তাকিয়ে দেখে সে যাত্রা। হার্ডিঞ্জ ব্রীজের বামদিকে তাকালেই চোখে পরে লালন শাহ সেতু। পাশপাশি দুই সেতু দুই সময়ের স্থাপনার স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে।
এই সৌন্দর্যটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থাপনা। সেখান থেকে সৌন্দর্যটা অন্যরকম। দুপুরের খাওয়া হিসেবে পদ্মার তীরে চটপটি দিয়ে সারলাম। কারণ ভাতের হোটেল ত্রি-সীমানায় নেই। কে আর কষ্ট করে এতদূর হেঁটে যায়! চটপটি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সাহিত্য নিয়ে তুমুল আলোচনা হলো।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সেখানেই বসে থাকলাম। শীতের দুপুর খুব দ্রুত গড়িয়ে যায়। টুপ করে সন্ধ্যা নামে। তারপর বিকেলের আলো নিভতে শুরু করলে আমরা আবার ফিরতি যাত্রা করলাম। পেছনে পরে রইলো একটি দিনের স্মৃতি। আবারো হয়তো সেখানে ঘুরতে যাবো। তবে প্রতিবারই অনূভুতি একেবারে আলাদা।