সেই দুই শিল্পপতির মধ্যে একজনের মেয়ে বিপুল অঙ্কের কর ফাঁকি থেকে বাঁচতে আবারও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। ট্যাক্সেস আপিলাত ট্রাইব্যুনালে জাল কাগজপত্র জমা দিয়ে ৪ কোটি টাকার বেশি কর মওকুফ করিয়ে নেন। পরে সংশ্লিষ্ট কর অফিসের তদন্তে বিষয়টি ধরা পড়ে। এ কাজে একজন হিসাববিদ (চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট) সহায়তা করেন। এ ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িত থাকায় হিসাববিদের এনরোলমেন্ট বাতিল করতে দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অব বাংলাদেশে (আইসিএবি) চিঠি দিয়েছে কর অফিস। একই সঙ্গে দুগ্রুপের সহযোগী সব প্রতিষ্ঠানে কর ফাঁকি খুঁজে বের করতে সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের ১২ এপ্রিল যুগান্তরে ‘দুই শিল্পপতির মেয়েকে বিশেষ সুবিধা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রেীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে যেখানে বলা হয়েছিল, কর অঞ্চল-১২ এর তৎকালীন অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার মো. সামসুদ্দিন (বর্তমানে খুলনা আপিলে কর্মরত) দুই শিল্পপতির মেয়েকে রিটার্ন জমার ক্ষেত্রে ‘বিশেষ’ সুবিধা দিয়েছেন। জের না থাকা সত্ত্বেও রিটার্নে কোটি টাকা সম্পদ দেখানো হয়েছে, এর বিপরীতে তারা আয়কর দিয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ও ৬ হাজার ৬০০ টাকা। আয়ের উৎস দেখানো হয়েছে, বিবিধ মালের ব্যবসা। আবার সম্পদের ওপর সারচার্জ আদায়ের বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেটি আদায় করেননি ওই কর্মকর্তা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সিআইসির তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের প্রেক্ষিতে কর অঞ্চল-১২ দুই করদাতার আয়কর নির্ধারণ করে। এরপর ডিভাইন গ্রুপের পরিচালক সামায়া হাসানকে ৪ কোটি ৮ লাখ এবং তানজিলা গ্রুপের পরিচালক তানজিলা মুনির অর্চিকে ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা পরিশোধের নোটিশ দেয়। সেই নোটিশে সংক্ষুব্ধ হয়ে করদাতা সামায়া হাসান কর আপিলে আপিল করেন। আপিলের রায় কর অঞ্চলের পক্ষে যায়। রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে ট্যাক্সেস আপিলাত ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা হয়। শুনানিতে করদাতাদের প্রতিনিধি মিজানুর রহমান এফসিএ ২০০৯-১২ করবর্ষ পর্যন্ত রিটার্নের কপি দাখিল করেন। হিসাববিদের জমা দেওয়া কাগজপত্র পর্যালোচনা করে ট্রাইব্যুনাল আয়কর পরিশোধ থেকে দায়মুক্তি দেন।
সূত্র জানায়, সামায়া হাসানের জন্ম ১৯৯৬ সালে হওয়ায় এবং ২০০৯-১০ করবর্ষের রিটার্নের (অর্থাৎ ১৩ বছর বয়সে রিটার্ন জমা দিয়েছেন) কপি ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়ায় পুরো ঘটনাটি সন্দেহজনক প্রতীয়মান হয়। এর পরিপ্রক্ষিতে ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া কাগজপত্র যাচাই করা হয়। জমা দেওয়া কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সব কাগজপত্র জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বানানো। যে টিআইএন’র (১০ সংখ্যার) বিপরীতে রিটার্ন জমা দেওয়া হয়েছে, সেটি সামায়া হাসানের নয়। জাহাঙ্গীর আলম নামের এক ব্যক্তির। কিন্তু হিসাববিদ অত্যন্ত সুকৌশলে ওই টিআইএনে রিটার্ন জমার দাবি করেন। ট্রাইব্যুনালকে ভুল বুঝিয়ে সেই দাবির প্রেক্ষিতে কর মওকুফের আদেশ দেন। এমনকি সংশ্লিষ্ট কর সার্কেলে (মানিকগঞ্জ) ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিপরীতে উচ্চ আদালতে আপিল না করতে জোর তদবির করেন।
সূত্র আরও জানায়, ইতোমধ্যেই সামায়া হাসান ফাঁকির দায় স্বীকার করে ১ কোটি টাকা কর পরিশোধ করেছেন। আর তানজিলা মুনির অর্চির কাছ থেকে কর আদায়ে সার্টিফিকেট মামলা করা হয়েছে। এ নিয়ে একাধিক শুনানি হয়েছে। অন্যদিকে ডিভাইন গ্রুপ ও তানজিলা গ্রুপের কর ফাঁকি খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
কর অঞ্চল-১২ থেকে আইসিএবিতে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, করদাতার কাছ থেকে লাভবান হয়ে মিজানুর রহমান এফসিএ জাল কাগজপত্র ট্যাক্সেস আপিলাত ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে রাষ্ট্রের ৪ কোটি ৮ লাখ টাকার ক্ষতি করেছেন, যা স্পষ্টতই তার পেশাগত অসদাচরণ। তাকে এখনই থামিয়ে না দিলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র রাজস্বের বিষয়ে বিরাট রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। এ অবস্থায় চিঠিতে মিজানুর রহমানের আইসিএবি এনরোলমেন্ট বাতিল করে পেশাজীবীর পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে অনুরোধ জানানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা যা বললেন : জাল কাগজপত্র দিয়ে কর মওকুফের অভিযোগের বিষয়ে হিসাববিদ মিজানুর রহমান এফসিএ বলেন, করদাতার পক্ষ থেকে যেসব ডকুমেন্ট দেওয়া হয়েছে, তা আমি ট্রাইব্যুনালে সরবরাহ করেছি এবং শুধু শুনানিতে অংশ নিয়েছি। এর আগের কোনো ঘটনাই জানা ছিল না। কর অঞ্চল-১২ থেকে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা সত্য নয়, ভিত্তিহীন।
কর ফাঁকিতে সহায়তায় জড়িত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে-এমন প্রশ্নের উত্তরে কর অঞ্চল-১২ এর কমিশনার মোহা. আবুল কালাম বলেন, কর ফাঁকিতে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তদন্তে এক সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করা হয়। অভ্যন্তরীণ তদন্তে কর্মকর্তার গাফিলতি ও কর্তব্যে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। পরে সেই তদন্ত প্রতিবেদন এনবিআরে পাঠিয়ে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এনবিআরের সদস্য (কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ বলেন, ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চালু করা হয়েছে। তাকে শুনানির জন্য ডাকা হয়েছে।
পেছনের ঘটনা : তানজিলা গ্রুপের পরিচালক তানজিলা মুনির অর্চি এবং ডিভাইন গ্রুপের পরিচালক সামায়া হাসান সম্পর্কে চাচাতো বোন। জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) দুজনেরই স্থায়ী ঠিকানা, যশোরের চৌগাছা। বর্তমান ঠিকানা মহাখালীর ডিওএইচএস। নিয়মানুযায়ী, স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করে টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) নিলে তাদের খুলনা কর অঞ্চলের করদাতা হওয়ার কথা। আর বর্তমান ঠিকানা ব্যবহার করলে ঢাকার কর অঞ্চল-৮-এর করদাতা হওয়ার কথা। কিন্তু সামায়া মানিকগঞ্জ (সার্কেল-২৬৩) ও অর্চি নায়ক-নায়িকাদের বিশেষায়িত সার্কেলের (সার্কেল-২৬২) করদাতা হিসাবে নিবন্ধন নেন।
অর্চি ২০১৯ সালের ২৬ জুন টিআইএন নেন। এতে আয়ের উৎস হিসাবে বিবিধ মালের ব্যবসা দেখানো হয়। ওইদিনই কর অঞ্চল-১২-এর অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার মো. সামসুদ্দিন (বর্তমানে খুলনা আপিলে কর্মরত) পূর্বের ৮ বছরের রিটার্ন দিতে করদাতাকে নোটিশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রিটার্নে অর্চি আয়ের উৎস হিসাবে বিবিধ মালের ব্যবসা উল্লেখ করেন এবং ৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকার নিট সম্পদ প্রদর্শন করেন। আর বার্ষিক আয় দেখান ২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। আর আয়কর দেন ৬ হাজার ৬০০ টাকা। দুই সপ্তাহ পর ১০ জুলাই কর নির্ধারণ প্রক্রিয়া শেষ করেন ওই কর্মকর্তা। একইভাবে এক বছর পর সামায়া ২০২০ সালের ৩ মার্চ টিআইএন নেন। রিটার্নে তার নিট সম্পদ দেখানো হয় ১৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। বার্ষিক প্রদর্শিত আয় দেখানো হয় ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এর বিপরীতে সামায়া কর দেন ৩ হাজার টাকা।
সিআইসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করদাতার প্রদর্শিত আয়ের ধরন, পরিমাণ প্রদর্শিত সম্পদের পরিমাণের সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। এ বিষয় যথাযথভাবে যাচাই না করেই সার্কেল কর্মকর্তা রিটার্নে প্রদর্শিত সম্পদকে পূর্বের জের হিসাবে মেনে নিয়ে অস্বাভাবিক তড়িঘড়ি করে কর নির্ধারণ সম্পন্ন করা হয়েছে, যা রাজস্ব স্বার্থপরিপন্থি ও দায়িত্বে অবহেলা এবং অপেশাদারিত্বের পরিচায়ক হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এতে আরও বলা হয়, করদাতার টিআইএন রেজিস্ট্রেশনের তারিখ, আয়কর দাখিলের তারিখ, চূড়ান্ত কর নির্ধারণের তারিখ এবং অন্য আনুষঙ্গিক প্রমাণাদির আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, করদাতার পূর্বের রিটার্ন নেই এবং তার পূর্বের সম্পদের জের থাকারও সম্ভাবনা নেই। স্থায়ী ঠিকানা যশোর এবং বর্তমান ঠিকানা মহাখালীর ডিওএইচএস হওয়া সত্ত্বেও টিআইএন’র অধিক্ষেত্র মানিকগঞ্জ (২৬৩ সার্কেল) ও ২৬২ সার্কেল কীভাবে হয়েছে তাও স্পষ্ট নয়।