• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৭:৩৩ অপরাহ্ন

লোডশেডিংয়ে হাবুডবু খাচ্ছে পুরো দেশ।

Reporter Name / ১১৯ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০২৩

একদিকে তীব্র গরম, অন্যদিকে ঘন ঘন লোডশেডিং। এতে সারা দেশে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। কাজ শেষে বাসায় ফিরে একটু বিশ্রাম বা শান্তিতে ঘুমানোরও জো নেই। শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের কষ্ট সবচেয়ে বেশি।

কেউ কেউ আইপিএস বা জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুতের অভাব মেটালেও দুর্মূল্যের বাজারে গরিব-খেটেখাওয়া মানুষের পক্ষে মোমবাতি জোগাড় করাই কষ্টসাধ্য। বিদ্যুৎ সংকটে বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে লোকসানের মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে প্রচণ্ড গরমে হিটস্ট্রোক, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগবালাই দেখা দিয়েছে।

কুমিল্লার দাউদকান্দিতে দাবদাহে অসুস্থ হয়ে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। চাঁদপুরে হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন আরও এক নারী। কুমিল্লা, চাটখিল ও ফুলবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অসুস্থ হয়েছেন অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। এদিন দুপুর পর্যন্ত ঠাকুরগাঁও আড়াইশ শয্যা হাসপাতালে গরমজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ৭০০ জন ভর্তি হয়েছেন। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) : উপজেলায় ছোট-বড় প্রায় দুই হাজার শিল্প-কারখানা রয়েছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে এসব কারখানার উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে লোকসানের মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। গোলাকান্দাইল এলাকার জুনায়েত ফ্যাশন গার্মেন্টের মালিক ইমরান হোসেন বলেন, আমার কারখানায় টি-শার্ট তৈরি হয়। কারখানাটি বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। দিনে অন্তত ১৫ থেকে ২০ বার বিদ্যুৎ যায়। কারখানায় নিয়োজিত প্রায় ৩শ শ্রমিক বিদ্যুৎ না থাকলে বসে সময় কাটায়। আগের তুলনায় এখন টি-শার্ট উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। শ্রমিকদের পুরো বেতন ঠিকই দিতে হচ্ছে।

ঝালকাঠি : শহরের চাঁদকাঠি এলাকার শ্রমজীবী আবুল বাসার বলেন, প্রচণ্ড গরমে মানুষ অতিষ্ঠ, এর মধ্যে চলছে অসহনীয় লোডশেডিং। আমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছি। বাসায় গরমে থাকা যায় না। সন্তানরা বিদ্যুতের অভাবে পড়ালেখাও করতে পারছে না। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো তারা কেউ আইপিএস কেউ বা জেনারেটর ব্যবহার করছে, আমরা তো মোমবাতিও ব্যবহার করতে পারি না।

টাঙ্গাইল : জেলায় দুই থেকে চার ঘণ্টা লোডশেডিং হওয়ার কথা থাকলেও হচ্ছে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। সরেজমিন দুপুরে শহরের বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ মার্কেটে বিদ্যুৎ নেই। টাঙ্গাইল বিদ্যুৎ বিভাগের সুপারিনটেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ওবায়দুল ইসলাম বলেন, টাঙ্গাইলে ১২০ থেকে ১২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা। সেখানে ১০০ থেকে ১০৫ মেগাওয়াট পাওয়া যাচ্ছে।

রাঙামাটি : লোডশেডিংয়ের কারণে হাসপাতালে রোগীদের সেবায় হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক ও নার্সদের। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, বর্তমানে জাতীয় গ্রিড থেকে চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে পালাক্রমে এলাকাভিত্তিক বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। রাঙামাটি সদর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শওকত আকবর বলেন, সারাক্ষণ বিদ্যুৎ যাওয়া-আসার কারণে রোগীদের ঠিকমতো সেবা দিতে পারছি না।

গোলাপগঞ্জ (সিলেট) : সোমবার সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীরা প্রচণ্ড গরমে কাতরাচ্ছেন। হাসপাতালের নিজস্ব জেনারেটর না থাকায় বিদ্যুৎ না থাকলে অন্ধকারে ডোবে হাসপাতালটি। চিকিৎসকরা মোবাইল টর্চ ও মোমবাতি জ্বালিয়ে রোগী দেখছেন। এ বিষয়ে সিলেট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর ডিজিএম গোপাল চন্দ্র শিব যুগান্তরকে বলেন, লোডশেডিং আগে থেকে কিছুটা কম হচ্ছে। আগে প্রতি ঘণ্টায় লোডশেডিং হলেও এখন ২ ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ নেওয়া হচ্ছে।

বান্দরবান : চাহিদার অর্ধেকও বিদ্যুৎ মিলছে না পর্যটন নগরী বান্দরবান জেলায়। শহরে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬-৭ ঘণ্টা এবং উপজেলা শহরগুলোতে ১০-১১ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। স্টেডিয়াম এলাকার ব্যবসায়ী রেজাউল করীম বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় সময়মতো মালামাল ডেলিভারি দিতে পারছি না। এ বিষয়ে বান্দরবান বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ আমির হোসেন জানান, চাহিদার বিপরীতে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চার বা পাঁচ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র। ঘাটতি থাকছে কমপক্ষে আরও সাত মেগাওয়াট।

চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামে চালু থাকা বিদ্যুৎ প্লান্টগুলোর উৎপাদন ১ হাজার ৩০৭ মেগাওয়াট। কিন্তু প্রতিদিন গড়ে চাহিদা রয়েছে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এই হিসাবে প্রায় ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি সামাল দিতে দিনে-রাতে লোডশেডিং করা হচ্ছে। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে জেনারেটরের ব্যবহার বেড়েছে। এতে জ্বালানি তেলের চাহিদাও বেড়ে গেছে। এদিকে লোডশেডিং পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় চট্টগ্রামে বিভিন্ন মার্কেটের চার্জার ফ্যান, আইপিএস ও জেনারেটরের দোকানে ক্রেতা সমাগম বেড়েছে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে অনেকেই এসব পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়ে গেছে।

নেত্রকোনা : সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন গ্রামাঞ্চলে। গ্রামাঞ্চলের গ্রাহকদের অভিযোগ, দিন-রাতে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। তবে উপজেলা পর্যায়ের শহরে লোডশেডিং কিছুটা কম। নেত্রকোনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১০৭ মেগাওয়াট, সরবরাহ হয়েছে এর অর্ধেকের মতো।

মানিকগঞ্জ : শহর ও গ্রামে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ ঘণ্টাই থাকে লোডশেডিং। জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার আব্দুর রশিদ মৃধা জানান, বর্তমানে দিনে প্রয়োজন ১৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ৯০ মেগাওয়াট। রাতে প্রয়োজন ১৬০ মেগাওয়াট। পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ১০০ মেগাওয়াট। তিনি জানান, শহরের তুলনায় গ্রামে লোডশেডিং বেশি।

রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) : ১৫ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে রায়পুরে। রায়পুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডিজিএম শাহাদাত হোসেন বলেন, চাহিদা ১৯ মেগাওয়াট। পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৯ মেগাওয়াট। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

বন্দর (নারায়ণগঞ্জ) : বন্দরে দিনে-রাতে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। লোডশেডিংয়ে কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহতসহ দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটছে। সন্ধ্যায় এবং মধ্যরাতে হুটহাট চলে যায় বিদ্যুৎ। এতে পড়াশোনা ও ঘুমের চরম দারুণ ব্যাঘাত ঘটছে।

মহেশপুর (ঝিনাইদহ) : ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে মহেশপুর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে টর্চলাইট ও ব্যাটারির মাধ্যমে আলোর ব্যবস্থা করে জরুরি চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে এই আলো পর্যাপ্ত না হওয়ায় জরুরি বিভাগের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।

মৌলভীবাজার : জেলায় চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকের চেয়ে কম। শহরের চৌমুহনী এলাকার ব্যবসায়ী জাকির হোসেন ও আলখাছ-উর রহমান বলেন, আমাদের ব্যবসা বিদ্যুৎনির্ভর। বিদ্যুৎ না থাকায় কাজ করতে পারছি না। মাস শেষে দোকান ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন দিয়ে লোকসান গুনতে হবে। মোস্তফাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুল করিম বলেন, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি নাকাল হচ্ছেন গ্রামাঞ্চলের মানুষ।

লক্ষ্মীপুর : স্থানীয়দের দাবি, জেলার অনেক এলাকায় এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে ২ ঘণ্টা থাকে না। লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় রায়পুর উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কার্যালয়ে হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় মৌখিকভাবে উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডিজিএম সাহাদাত হোসেন রায়পুর থানা পুলিশকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বলেছেন।

যশোর : বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, যশোর শহরে প্রতিদিন ৬২ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। সেখানে সর্বোচ্চ সরবরাহ হচ্ছে ৩৮-৪০ মেগাওয়াট। শহরের কাজীপাড়ার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, দিনে-রাতে ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। সারাদিন পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না।

রাজশাহী ও চারঘাট : রাজশাহী অঞ্চলে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি-নেসকোর বিদুতের চাহিদা ছিল ৫১৮ মেগাওয়াট। আর বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়েছে ৪৪৩ মেগাওয়াট। এদিন বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল ৭৫ মেগাওয়াট। যেটি লোডশেডিং দিয়ে সমন্বয় করা হচ্ছে। চারঘাটে বিদ্যুৎ থাকে মাত্র ১০ ঘণ্টা।

এছাড়া লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, সুনামগঞ্জ ও জামালগঞ্জ, ফেনী, নরসিংদীর বেলাব, চাঁদপুরের কচুয়া, দিনাজপুরের হাকিমপুর ও বিরামপুর, নাটোরের বড়াইগ্রাম ও বাগাতিপাড়া, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, গৌরীপুর ও ধোবাউড়া, বান্দরবানের লামা, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, নেত্রকোনার কেন্দুয়া ও কলমাকান্দা, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি ও চৌহালী, কুমিল্লার লাকসাম, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর, যশোরের কেশবপুর, পটুয়াখালীর দশমিনা ও দুমকি, সিলেটের গোয়াইনঘাট ও রংপুরের কাউনিয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, এসব এলাকায়ও লোডশেডিংয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন মানুষ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category